খাদ্যে নকল ভেজাল বন্ধে দরকার সামাজিক সচেতনতা ডক্টর শেখ সালাহ্উদ্দিন আহ্মেদ

খাদ্যে ভেজাল যেন নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখির শেষ নেই। আইন প্রণয়নের দিক থেকেও নেই কোন ঘাটতি। কিন্তু রক্তপিপাসু ভেজালকারী ডাক্রুলাদের কিছুতেই নিরস্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।ভেজাল ছাড়া কোনো খাদ্যপণ্য কেনা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি ফলমূল কিনেও নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে না। হোটেলে যে মুরগি কিংবা গরু বা খাসির মাংস পরিবেশন করা হয় তা নিয়ে সংশয় দানা বেঁধে উঠছে সেটি মরা মুরগি কিংবা অন্য কোনো জন্তুর মাংস কিনা। ফরমালিনসহ নানা বিষাক্ত রাসায়নিক দিয়ে ফলমূল ও মাছ তরতাজা রাখা হয়, যা খেয়ে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে জীবনঘাতী রোগে। এমনকি পকেটের টাকা খরচ করে বোতলজাত যে বিশুদ্ধ পানি কেনা হয় তার বিশুদ্ধতা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।খাদ্যপণ্যে ভেজাল জনস্বাস্থ্যের জন্য এ মুহূর্তে এক নম্বর হুমকি। এ হুমকি রোধে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও সামাজিক সচেতনতার অভাবে তা কোন কাজে আসছে না। খাদ্যে ভেজাল এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, কোন সচেতন মানুষের পক্ষে কোন খাদ্যই স্বস্তির সঙ্গে খাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে যে জুস বা পানীয় বিক্রি হয় তার সিংহভাগই মানসম্মত নয়। নামিদামি কোম্পানির তৈরি মিষ্টি কতটা স্বাস্থ্যসম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বাজারে যে ঘি, বাটার অয়েল ও ভোজ্যতেল বিক্রি হয় তার সিংহভাগই নকল ভেজাল। শিশু খাদ্যের মানও এখন প্রশ্নবিদ্ধ। দুধে ভেজাল যুগ যুগ ধরে।এখন যেসব প্যাকেটজাত দুধ বিক্রি হয় তার বেশির ভাগই মানসম্মত নয়। আম, কলা, আপেল, খেজুর ইত্যাদি ফল খেতে ভয় পায় এমন মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো ফল পুষ্টির বদলে মানুষকে আরও রোগাক্রান্ত করছে।খাদ্য সামগ্রী ও কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রণের খবর ছড়িয়ে পড়ার ফলে দেশের সাধারণ ভোক্তারা উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন। সমপ্রতি হাইকোর্ট খাদ্যে ব্যাপক ভেজাল মেশানোর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের কাছে জানতে চেয়েছেন। হাইকোর্ট তার নির্দেশে বলেছেন, বারবার বলার পরও ভয়ঙ্কর এ অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। সরকারের ঢিলেঢালা মনিটরিং ব্যবস্থা এবং ভেজালের বিরুদ্ধে আইনের যথার্থ প্রয়োগ না হওয়ার কারণেই খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর প্রবণতা অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।উল্লেখ্য, এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ও কৃষক খাদ্য সামগ্রীতে এবং কৃষি পণ্যে মানুষ ও প্রাণীর জীবনের প্রতি হুমকিস্বরূপ মারাত্মক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে আসছে অতি মুনাফার লোভে। যেসব রাসায়নিক দ্রব্য খাদ্যে মেশানো হচ্ছে তা মানবদেহের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে এসব দ্রব্যের আমদানি গত দেড় যুগ আগেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ সেগুলোই অবলীলায় মেশানো হচ্ছে।১৬ কোটি মানুষের জীবনের বিরুদ্ধে মুষ্টিমেয় অসাধু ব্যবসায়ী এভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও সরকার নির্বিকার। একজন অপরাধীকে ধরা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া তো দূরে থাক, বরং কঠোর ভেজালবিরোধী আইনের প্রয়োগ ও খোদ আইনটিই শিথিল করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ অপরাধের গভীরতা বিচারে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি যেখানে মৃত্যুদ-ের প্রস্তাব করে, মন্ত্রিসভা তা কাটছাঁট করে ১৪ বছরের জেল দেয়ার সুপারিশ করে।দুধে মেলামাইন মেশানোর অপরাধে চীনে যেখানে অপরাধীর মৃত্যুদ- কার্যকর হয়, বাংলাদেশে ঠিক একই অপরাধে শাস্তি হয় মাত্র তিন মাস জেলের।এ ধরনের অপরাধের কোন শাস্তি না হওয়ার কারণেই বাংলাদেশে আজ খাদ্যে ভেজাল মেশানো মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এখানেও অপরাধীরা রাজনৈতিক আশ্রয় পাচ্ছে। এদিকে প্রায় প্রতিটি খাদ্যসামগ্রীর বিষক্রিয়ার ফলে কিডনি ও লিভারের অসুখে শিশুসহ সব বয়সের মানুষ ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের উদাসীনতা আসলে দেশবাসীর বিরুদ্ধে, খাদ্যে ভেজালকারীদের পক্ষে যাচ্ছে। সরকারকে খাদ্যে ভেজালকারীর বিরুদ্ধে জনস্বাস্থ্যের পক্ষে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।খাদ্যে নকল ভেজাল বন্ধে সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। এজন্য দরকার সামাজিক সচেতনতা। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠলে এ আপদ থেকে সহজেই নিস্তার পাওয়া যাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে নকল ভেজালের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। খাদ্যে ভেজালকারীদের সামাজিকভাবে চিহ্নিত করে কঠোর সাজার ব্যবস্থা করতে হবে। ভেজাল বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগ নেবে_ আমরা তেমনটিই দেখতে চাই।

0 Comments

There are no comments yet

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seven − 2 =

Back to top