নোয়াখালীতে মুদি দোকানেও বিক্রয় হচ্ছে ভেজাল ওষুধ

নোয়াখালীতে মুদি দোকানেও বিক্রয় হচ্ছে ভেজাল ওষুধ

জুয়েল রানা লিটন, জেলা প্রতিনিধি, নোয়াখালী ঃ জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এখন মরণফাঁদ। র‌্যাব এবং জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ভেজাল ও ফুড সাপ্লিমেন্ট ওষুধের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযান চালিয়ে জেল জরিমানা করলেও নোয়াখালী সিন্ডিকেট চক্রের অপতৎপরতা থামেনি। অনেক নামিদামি কোম্পানির ওষুধও ভেজাল হচ্ছে।

একদিকে, বাড়ছে ভেজাল ওষুধ তৈরির কারখানা অন্যদিকে পাল্লা দিয়েও বাড়ছে ওষুধের দাম। নকল হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক, গ্যাস্ট্রিক ও হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধ এবং ভারত থেকে আমদানিকৃত নিষিদ্ধ যৌন উত্তেজক ওষুধ।

রিকসাচালক আইয়ুব আলী জানান, “ রিকশা চালিয়ে এত কষ্ট করে আয় করে ঠিকমত বাজার ও মাছ না কিনে ওষুধ কিনি। কিন্তু তা ভেজাল শুনে মনের কষ্ট রাখার জায়গা নেই।” অত্যন্ত আক্ষেপের সাথে সংবাদকর্মী পরিচয় পেয়ে অভিযোগ করলেন জিয়ানগরের রিকশাওয়ালা ছাবির আলী (৫৬)। কাঁচা-পাকা দাড়ির শীর্ণ কায়ার এই খেটে খাওয়া রিকশাওয়ালার মনের প্রশ্ন যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে আয় হয় তা দিয়ে বৃদ্ধা মাতা ও নিজের অসুস্থ স্ত্রীর জন্য কেনা ওষুধগুলো কি ভেজাল না আসল। রোগ নির্মূলের বদলে সে আরো আক্রান্ত হচ্ছে কিনা জানেনা। মেয়াদউত্তীর্ণ ওষুধ খাচ্ছে কিনা বোঝে না। এমনই লোকের সংখ্যা অসংখ্য।

সম্প্রতি, দেশের বিভিন্ন জেলার ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ আটক করে নষ্ট করার ঘটনা শুনে অসংখ্য মানুষের মনের মাঝে এমনই প্রশ্ন আবার জেগেছে। এছাড়া জেলার বিভিন্ন স্থানে ব্যবসার আড়ালে ভেজাল ওষুধ তৈরির কারখানা যেন মানুষকে রীতিমত ভাবিয়ে তুলেছে। সবার একই প্রশ্ন ওষুধ নামে আমরা কী খাচ্ছি।

সূত্রমতে, নোয়াখালী অঞ্চলের কয়েক হাজার ওষুধের দোকান এবং কয়েক শত হাতুড়ে ডাক্তার রয়েছে। জেলার বহু গ্রামে-গঞ্জে মুদি ও চা দোকানেও ওষুধ বিক্রি হয়। শহরে ওষুধের দোকানে সেলসম্যান থাকতে থাকতে গ্রামে এসে ডাক্তার সেজে চেম্বার খোলে। চেম্বারে রোগী দেখার পাশাপাশি চলে দেশি-বিদেশি ওষুধ বিক্রি।
প্রেসক্রিপশন ছাড়া হরহামেশা চলছে ওষুধের বেচা-কেনা। মেয়াদোত্তীর্ণ এবং ভেজাল ওষুধে সয়লাব করেছে নোয়াখালী অঞ্চলের বিভিন্ন দোকান। ভারতীয় ফুড সাপ্লিমেন্ট নিষিদ্ধ ওষুধ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে দেদার। আর এসব দেখভালের জন্য নোয়াখালী ওষুধ প্রশাসনের চারজন কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে যে কর্মকান্ড চালানো হচ্ছে তাতে জনস্বাস্থ্য রীতিমত হুমকির সম্মুখীন। মাত্র চার-পাঁচজন লোকবল দিয়ে এই বিপুলসংখ্যক ওষুধের দোকান এবং জীবন রক্ষাকারী এই কর্মকা-ের মনিটরিং করা আদৌ সম্ভব নয়।

ওষুধ ব্যবস্থার এ ভেজালের কথা শুনে শুধু রিকশাচালক আইয়ুব আলী চিন্তিত নন, বরং এ জিজ্ঞাসা পুরো অঞ্চলের আমজনতার। কারণ এমন কোনো পরিবার নেই যেখানে ওষুধের প্রয়োজন নেই। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ যেন তাদের জীবনে ব্যুমেরাং না হয় এমন নিবেদন সংশ্লিষ্টদের।

ওষুধ প্রশাসনে জনবল সংকটের কারণে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী দিনের পর দিন চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ, ভেজাল ও নাম সর্বস্ব ওষুধ কেনাবেচা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রি করেও জনসাধারণের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে। এসব অবৈধ ব্যবসার সাথে ওষুধ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির কোনো কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধিও জড়িত বলেও অভিযোগ রয়েছে। যদিও বিসিডিএস’র কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে সম্প্রতি লিফলেট বিতরণ করে বলা হয়েছে ‘নকল ওষুধ প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতা দেশ ও জাতির শত্রু, এদের ধরিয়ে দিন, সমিতিকে খবর দিন।’ ওষুধ প্রশাসনের জনবল সংকট কাটিয়ে তুলতে বর্তমান জেলা প্রশাসন ও র‌্যাাব তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

সূত্রমতে, নোয়াখালী অঞ্চলের বিভিন্ন ওষুধ বাজারে প্রায় অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানের শতাধিক ফুড সাপ্লিমেন্ট আইটেম রয়েছে। যা রোগীদের প্রভাবিত করে বেশি দামে ওষুধ হিসেবে বিক্রি করা হয়। অনেক নামিদামি ডাক্তাররা ইদানীং ব্যাপকহারে প্রেসক্রিপশনে ফুড সাপ্লিমেন্ট লিখছেন। নোয়াখালীর বাজারে কেলসিম্যাগ, ওলিগো, কেয়ার, ওভাকেয়ার, গোল্ডকেয়ার, লিবেরিল, প্রেগনাকেয়ার, প্রিসজেল, হাইলন, এব্যানা, বিয়ন, ক্যাসপো, ভিএম ক্যাল, ভিএম-৩২, স্টিমুলিন এক্স, এসপি গোল্ড, প্রিমা-১০০০, মেগা-৩, গিংগুবা-১০০, বনক্যাল-ডি, অস্টিওমিন, ভিটা এক্সএল, অ্যামাইনো এনার্জি, সি-জয়েন্টিন, বোন মিল, ইপো, এস্টাভিট, সি-ক্যাল পাস, প্রোবায়েটিক-৪, এনডি ক্যাল, অর্থপাস, বনগার্ড, ওনিক্স, রক্সেন, বিলোবা পাস, বোন ডি এস, সিনো-ই, জয়েন্ট বিল্যাক্স, ওমাল, জেলপাস, ইভোনিয়া, মাল্টিজেন, এসডি পাস, স্টেনিন ই, বি-গোল্ডসহ শতাধিক এর মতো আইটেম পাওয়া যাচ্ছে। আর ওষুধের বাজারে এখন নানা আয়ুর্বেদীক ব্যানারে যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট ও সিরাপ বিক্রি হচ্ছে। গ্যাসের ট্যাবলেট বিক্রি হচ্ছে নাম না জানা কোম্পানির নামে। আদৌ এ ওষুধে কোনো কাজ হয় কিনা তা জানা নেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নোয়াখালী জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মজিবুল হক বলেন, এ বিষয়ে শীঘ্রই জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

0 Comments

There are no comments yet

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

16 + 2 =

Back to top