ভেজাল নির্মূলে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে

মায়ের গর্ভে যখন একটি শিশুর জন্মের প্রক্রিয়া শুরু হয়, সেসময় থেকে পরবর্তীকালে বেড়ে ওঠা এবং মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের জন্য খাবার প্রয়োজন। খাদ্য গ্রহণ না করলে মানুষ বাঁচতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় সব খাদ্যদ্রব্যেই মেশানো হচ্ছে ভেজাল। একারণে কোন খাবারই এখন আর নিরাপদ নয়। ফলমূলে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কার্বাইডসহ নানা বিষাক্ত কেমিক্যাল, মাছে ও দুধে ফরমালিন, চানাচুর-জিলাপিতে মবিল, সবজিতে কীটনাশক, বিস্কুট-আইসক্রিম-জুস-সেমাই-আচার-নুডলস্ এবং মিষ্টিতে টেক্সটাইল ও লেদার রং, পানিতে ক্যাডমিয়াম, লেড, ইকোলাই, লবণে সাদা বালু, চায়ে করাতকলের গুঁড়ো, গুঁড়ো মসলায় ভুসি, বালি, কাঠ, ইটের গুঁড়ো, বিষাক্ত গুঁড়ো রং, মুড়িতে হাইড্রোজ এবং অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীতে দেদারছে মেশানো হচ্ছে ভেজাল।

খাদ্যে রঙ মেশানো এখন একটি অতি সাধারণ ঘটনা। খাদ্যকে আকর্ষণীয় করতে বিভিন্ন ধরনের রঙ মেশানো হয়ে থাকে। যেমন- কপার, জিংক, ইন্ডিগোবেজ্ড ডাই ইত্যাদি। অ্যালকোহল এমনকি খাবার সসে বিভিন্ন ধরনের রঙ মেশানো হয়ে থাকে। এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। এসব রঙ থেকে হয়তো তাৎক্ষণিক কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় না, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সারের মতো রোগ দেখা দিতে পারে।
চালকে আরও উজ্জ্বল করতে, মুড়িকে আরও সাদা ধবধবে করতে এবং মাছ, মাংস ও সবজি রক্ষণাবেক্ষণ করতে এটিকে প্রিজারভেটিভ হিসেবে ইউরিয়া ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় খামারিরা গরু পালনে বিশেষ করে কোরবানির জন্য গরু  স্বল্প সময়ে মোটাতাজা করতে গরুর খাবারে ইউরিয়া মিশিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ইউরিয়া গরুর শরীরে মিশে যায় এবং ওই গরুর মাংস খেলে দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন রকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, যেমন- শরীর স্থূলকায় হয়ে যায়, পায়ে এক ধরনের ঘা হয়, ত্বকে ফোসকা পড়ে, এমনকি কিডনি ও লিভারের মারাত্মক ক্ষতি হয়।
ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে সাধারণত স্টিল মিলে, ওয়েল্ডিংয়ের কাজে এবং আতশবাজি বা ছোট বোমা বানানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা এটিকে বিভিন্ন ফল পাকানোর কাজে ব্যবহার করে আসছে। ক্যালসিয়াম কার্বাইড পানি বা জলীয় বাষ্পের সঙ্গে মিশে ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সাইড ও এসিটাইলিন গ্যাস সৃষ্টি করে। এই এসিটাইলিন গ্যাস ইথিলিনের মতো কাজ করে। ফলে সহজেই আমসহ যে কোনো কাঁচা ফল পেকে যায়। ক্যালসিয়াম কার্বাইড ফলের ত্বক ভেদ করে ফলের ভেতরে শাসে ঢুকে যায়। এই ক্যালসিয়াম কার্বাইডে মারাত্মক বিষ হিসেবে মিশ্রিত থাকে আর্সেনিক ও ফসফরাস। এই আর্সেনিক ও ফসফরাস ফলের ভেতর ঢুকে যায়। ফল পাকার পরও ভেতরে এই আর্সেনিক ও ফসফরাস থেকে যায়। এভাবে কার্বাইড দিয়ে পাকানো ফল খেলে শরীরের ভেতর বিষক্রিয়া চলতে থাকে। তাৎক্ষণিকভাবে হয়তো কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় না, তবে দীর্ঘমেয়াদে কিডনি অথবা লিভারের সমস্যা ছাড়াও সেগুলো বিকল হয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া।
পচনশীল খাবার যাতে সহজে না পচে, অর্থাৎ অধিক সময় ধরে পচনশীল খাবার, যেমন- ফলমূল, মাছ-মাংস, সবজি এমনকি দুধ ও দুগ্ধজাত মিষ্টি সংরক্ষণে ফরমালিনের সংমিশ্রণ করা হচ্ছে। ফর্মালডিহাইড দেখতে সাদা পাউডারের মত। পানিতে সহজেই দ্রবনীয়। শতকরা ৩০-৪০ ভাগ ফর্মালিনের জলীয় দ্রবণকে ফর্মালিন হিসাবে ধরা হয়। ফর্মালিন সাধারণত টেক্সটাইল, প্লাষ্টিক, পেপার, রং, কনস্ট্রাকশন ও মৃতদেহ সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়। ফরমালিনে ফরমালডিহাইড ছাড়াও মিথানল থাকে, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। লিভার বা যকৃতে মিথানল এনজাইমের উপস্থিতিতে প্রথমে ফরমালডিহাইড এবং পরে ফরমিক এসিডে রূপান্তরিত হয়। দুটোই শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ফরমালিনের বিষক্রিয়ার ফলে ফরমালডিহাইড চোখের রেটিনাকে আক্রান্ত করে রেটিনার কোষ ধ্বংস করে। ফলে মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাৎক্ষণিকভাবে ফরমালিন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, কার্বাইডসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহারের কারণে পেটের পীড়া, হাঁচি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, বদহজম, ডায়রিয়া, আলসার, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে এসব রাসায়নিক পদার্থ লিভার, কিডনি, হার্ট, ব্রেন সব কিছুুকে ধ্বংস করে দেয়। লিভার ও কিডনি অকেজো হয়ে যায়। হার্টকে দুর্বল করে দেয়। স্মৃতিশক্তি কমে যায়। ফরমালিনযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করার ফলে পাকস্থলী, ফুসফুস ও শ্বাসনালিতে ক্যান্সার হতে পারে। অস্থিমজ্জা আক্রান্ত হওয়ার ফলে রক্তশূন্যতাসহ অন্যান্য রক্তের রোগ, এমনকি ব্লাড ক্যান্সারও হতে পারে এবং এতে মৃত্যু অনিবার্য। সাধারণত ছোট আকারের এক বোতল ফরমালিন এক ড্রাম পানিতে মেশানো হয়। ড্রামে মেশানো পানিতে পোকামাকড়, মশা-মাছি যদি পড়ে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি মারা যায়।
ফরমালিন ও অন্যান্য কেমিক্যাল সামগ্রী সব বয়সী মানুষের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে। ফরমালিনযুক্ত দুধ, মাছ, ফলমূল এবং বিষাক্ত খাবার খেয়ে দিন দিন শিশুদের শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে। কিডনি, লিভার ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট, বিকলাঙ্গতা, এমনকি মরণব্যাধি ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে শিশু-কিশোররা।
ভেজাল খাদ্যের প্রভাবে দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তাঁর পরিবারই শুধু জানেন কি ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে তাদের উপর দিয়ে। দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত গরীব রুগীদের ক্ষেত্রে এসব জটিল রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় চিকিৎসার অভাবে অনেক রোগী আবার বিনাচিকিৎসায় অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। শুধু তাই নয়, রুগীকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে অনেক পরিবার আর্থিকভাবেও নিঃস্ব হয়ে পড়েন।
ভেজাল সম্পর্কে জনকণ্ঠ পত্রিকায় ‘অনিরাপদ খাদ্য: শত রোগের উৎস’ শিরোনামে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে (সংক্ষেপিত)ঃ “বিশ্লেষকরা বলছেন, সুন্দর স্বাস্থ্য ও সুস্থ থাকার জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্যের বিকল্প নেই। কিন্তু ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্য খাওয়ার জন্য অধিকাংশ মানুষ অসুস্থ হয়। বাংলাদেশে ভেজাল খাদ্য, বিষাক্ত খাদ্য, রাসায়নিক দ্রব্য মিশানো খাদ্য, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যে সয়লাব হয়ে গেছে। এজন্য এদেশের মানুষ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
“দেশে ভেজাল ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থযুক্ত ফল, শাকসবজি, খাদ্যশস্য, মাছ, মাংস, ডিম, দুধসহ প্রায় সব খাদ্যে সয়লাব হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যকর খাদ্য পাওয়া মুশকিল। ফল, শাকসবজি, খাদ্যশস্য দ্রুত বৃদ্ধি, বড় করা, পরিপক্ব, পাকানো, আকর্ষণীয় করা, সংরক্ষণ, রোগ ও পোকা দমনের জন্য অসাধু ব্যবসায়ী ও কৃষকরা রাসায়নিক পদার্থ, হরমোন এবং কীটনাশক দিয়ে থাকে।
“আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায়, খাদ্যে কৃত্রিম রাসায়নিক পদার্থের বিষক্রিয়ায় মানবদেহে হৃদপিন্ড, যকৃৎ ও কিডনির বিভিন্ন সমস্যা, ক্যান্সার, হাঁপানি, অন্ত্রে ব্যথা, পেটের পীড়া, গর্ভপাত, বন্ধ্যত্ব, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুর ক্ষতি, ফুসফুসের রোগ, ডায়াবেটিস, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, মাংসপেশীর সংকোচন, বমি, মুখে লালা আসা, চোখ দিয়ে পানি পড়া, মাথাব্যথা, চোখের মণি ছোট হওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা, দুর্বলতা, তলপেটে ব্যথা, খিঁচুনি ইত্যাদি রোগ ও লক্ষণ দেখা দেয়।
“কিডনি ফাউন্ডেশন থেকে জানা যায়, দেশের ১৬ ভাগ রোগী কিডনি রোগে আক্রান্ত এবং রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত খাদ্য গ্রহণের ফলেই কিডনি রোগ হচ্ছে। প্রতিমাসে ক্যান্সার, কিডনি ও লিভার রোগী দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। দীর্ঘদিন বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে গর্ভবতী মা ও তার পেটের ভ্রƒণ ক্ষতি হচ্ছে, প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হচ্ছে, সন্তানও ক্যান্সার, কিডনিসহ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
“১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেয়া ও ভেজাল খাদ্য বিক্রি করার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড এবং ১৪ বছরের কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়াও জরিমানাসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। বিএসটিআই-এর ভেজালবিরোধী অভিযান, প্রশাসনের মোবাইল কোর্ট, পরিবেশবাদীদের আন্দোলনসহ বিভিন্ন তৎপরতার পরেও ভেজাল খাদ্য উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ করা যাচ্ছে না।”
১২ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ক্যাফেটেরিয়া ও সবুজ চত্বরে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘দৃষ্টি’ আয়োজিত ফল উৎসব ও সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মধ্যে ফল বিতরণ অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার মোঃ ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন জরুরী। এজন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আম-কাঠালসহ মৌসুমী ফলে ক্ষতিকর ফরমালিনসহ বিভিন্ন ধরণের কেমিক্যাল ব্যবহারের কারণে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে। এই হুমকি থেকে রক্ষায় ইতোমধ্যে জাতীয় সংসদে ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন পাস হয়েছে। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় ওই আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশে আইন আছে কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে আইনের বাস্তবায়ন দৃষ্টিগোচর হয় না। কিছু অসাধু ব্যক্তি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে সমাজে অন্যায় কার্যকলাপ সমানে চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার কঠোর হস্তে দমন করতে পারছে না। ভেজালের ক্ষতিকর প্রভাব সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে সমাজের উঁচুস্তরের নাগরিকরা যেমন- ধর্নাঢ্য ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা, এমপি-মন্ত্রী পর্যন্ত কেউই রেহায় পাচ্ছেন না। ভেজালের কাছে বলতে গেলে এখন আমরা সবাই প্রায় অসহায়।
কঠোর আইন করেও ভেজাল দূর করা যাচ্ছে না। তাই সরকারের চেষ্টার পাশাপাশি জনগণকে ভেজাল সম্পর্কে আরও সতর্ক হতে হবে। কিভাবে ভেজালদুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় সে পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে। (পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে নেয়া) নিম্নের কয়েকটি পদ্ধতি অনুসরণে খাদ্যদ্রব্যে ফর্মালিন দূর করা অনেকাংশে সম্ভব। কয়েকটি নমুনা-
মাছের ক্ষেত্রেঃ ফরমালিনবিহীন মাছের ফুলকা উজ্জ্বল লাল র্বণ, চোখ ও আঁইশ উজ্জ্বল হয়, শরীরে আঁশটে গন্ধ পাওয়া যায়, মাছের দেহ নরম হয়। অন্যদিকে ফরমালিনযুক্ত মাছের ফুলকা ধূসর, চোখ ঘোলাটে ও ফরমালিনের গন্ধ পাওয়া যায়। আঁইশ তুলনামূলক ধূসর বর্ণের হয়, শরীরে আঁশটে গন্ধ কম পাওয়া যায়, দেহ তুলনামূলক শক্ত হয়। পরীক্ষাতে দেখা গেছে- পানিতে প্রায় ১ ঘন্টা মাছ ভিজিয়ে রাখলে ফর্মালিনের মাত্রা শতকরা ৬১ ভাগ কমে যায়। লবণাক্ত পানিতে ফর্মালিন দেওয়া মাছ ১ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখলে শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ ফর্মালিনের মাত্রা কমে যায়। প্রথমে চাল ধোয়া পানিতে ও পরে সাধারণ পানিতে ফর্মালিন যুক্ত মাছ ধুলে শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ ফর্মালিন দূর হয়। সবচাইতে ভাল পদ্ধতি হল ভিনেগার ও পানির মিশ্রনে (পানিতে ১০% আয়তন অনুযায়ী) ১৫ মিনিট মাছ ভিজিয়ে রাখলে শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ ফর্মালিনই দূর হয়।
ফল ও সবজির ক্ষেত্রেঃ যে কোন ধরনের রাসায়নিকই দেয়া হোক না কেন যদি আমরা একটু সচেতন হই তাহলে ফল খাওয়া সম্ভব। ফল খাওয়ার আগে এক ঘণ্টা বা তার চেয়ে একটু বেশী সময় ফলগুলো পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। ভিনেগার ও পানির মিশ্রনে ফল ডুবিয়ে রাখলে শতকরা ৯৯ ভাগই ফর্মালিন দূর করা সম্ভব। সবজি রান্না করার আগে গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখুন। বেগুনে এক ধরনের রাসায়নিক স্প্রে ব্যবহার করা হয়। এই রাসায়নিক স্প্রে ব্যবহার ক্ষতিকর না যদি নিয়মানুসারে দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশের কৃষকেরা এ ব্যাপারে অজ্ঞ। তারা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। প্রতিটি কীটনাশকের ক্রিয়া একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত থাকে। যেমন- একটি কীটনাশকের সেলফ লাইফ বা জীবন সীমা ৭ দিন, তার মানে কীটনাশকটা ব্যবহারের ৭ দিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকবে, যা কীটপতঙ্গের জন্য ক্ষতিকর। তাই কৃষকদের উচিত কীটনাশক ব্যবহারের অন্তত ৭ দিন পর ফলন তোলা। কিন্তু তারা তা না করে ২-১ দিনের মাঝেই ফলন তোলেন। ফলে কীটনাশকের ক্রিয়া ক্ষমতা থেকে যায়, যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে গ্রামে অথবা শহরে বাস করা মানুষদের উপর। তাই বাজারে সতেজ, উজ্জ্বল বেগুন না কিনে কিছুটা অনুজ্জ্বল, কিছুটা পোকায় আক্রান্ত এমন বেগুন কেনাই ভালো।
এখন আমের মৌসুম চলছে। আম পছন্দ করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। বাজারে গেলেই এখন পাকা আমের গন্ধে মন উচাটন হয়ে ওঠে। হরেক রকমের আম পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। নামে যেমন বাহার, খেতেও তেমন সুস্বাদু। ছোটবেলায় আম-দুধ-ভাত দিয়ে মেখে খাওয়ার স্মৃতি কমবেশি সবারই আছে। কিন্তু ছোটবেলার সেই সুস্বাদু আমে এখন প্রচুর কৃত্রিম ভেজালে পরিপূর্ণ। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ফরমালিনসহ নানা রকম কেমিক্যাল ব্যবহার করে আমকে এখন আতঙ্কের ফল হিসেবেই পরিচিতি করে তুলছে। এসব কেমিক্যাল মানুষের জন্য শুধু ভয়াবহই না মৃত্যুর আশঙ্কাও তৈরি করে। তবে কেমিক্যালমুক্ত আম চিনতে নিচের টিপসগুলো অনুসরণ করা যেতে পারেঃ
* প্রথমেই লক্ষ্য করুন, আমের গায়ে মাছি বসছে কি-না। এর কারণ, ফরমালিনযুক্ত আমে মাছি বসে না।
* আম গাছে থাকা অবস্থায় বা গাছপাকা আম হলে লক্ষ্য করে দেখবেন যে আমের শরীরে এক রকম সাদাটে ভাব থাকে। কিন্তু ফরমালিন বা অন্য রাসায়নিকে চুবানো আম হবে ঝকঝকে সুন্দর।
* কার্বাইড বা অন্য কিছু দিয়ে পাকানো আমের শরীর হয় মোলায়েম ও দাগহীন। কেননা আমগুলো কাঁচা অবস্থাতেই পেড়ে ওষুধ দিয়ে পাকানো হয়। গাছ পাকা আমের ত্বকে দাগ পড়বেই।
* গাছপাকা আমের ত্বকের রঙে ভিন্নতা থাকবে। গোঁড়ার দিকে গাঢ় রঙ হবে এবং সেটাই স্বাভাবিক। কার্বাইড দেওয়া আমের আগাগোড়া হলদেটে হয়ে যায়, কখনো কখনো কার্বাইডের ডোজ একটু বেশি পড়লে সাদাটেও হয়ে যায়।
* হিমসাগর ছাড়া আরও নানান জাতের আম আছে যেগুলি পাকলেও সবুজ থাকে এবং পাকার পর অত্যন্ত মিষ্টি হয়। গাছপাকা হলে এইসব আমের ত্বকে বিচ্ছিরি দাগ পড়ে। কিন্তু ওষুধ দিয়ে পাকানো হলে সেই আমের শরীর হয় মসৃণ ও সুন্দর।
* আম নাকের কাছে নিয়ে ভালো করে শুঁকে কিনুন। গাছ পাকা আম হলে অবশ্যই বোটার কাছে ঘ্রাণ থাকবে। ওষুধ দেওয়া আম হলে কোনো গন্ধ থাকবে না, কিংবা বিচ্ছিরি বাজে গন্ধ থাকবে।
* আম মুখে দেওয়ার পর যদি দেখেন যে কোনো সৌরভ নেই কিংবা আমে টক বা মিষ্টি কোনো স্বাদ নেই, বুঝবেন সে আমে ওষুধ দেওয়া।
* আম কেনা হলে কিছুক্ষণ রেখে দিন। এমন কোথাও রাখুন যেখানে বাতাস চলাচল করে না। গাছ পাকা আম হলে গন্ধে মৌ মৌ করবে চারপাশ। আর ওষুধ দেওয়া আম হলে মিষ্টি গন্ধের অস্তিত্বই পাবেন না।
* আমের গায়ে সাধারণত এক ধরনের সাদা পাউডারের মতো থাকে। যা পানিতে বা ফরমালিনে চুবালে চলে যায়, এটাও খেয়াল রাখা দরকার।
* কেমিক্যালে পাকানো আম হলুদ না হয়ে সাদার মত রং ধারণ করে। অনেক সময় ক্রেতার নজর কাড়তে ও আমের গায়ে থাকা দাগ দূর করতে এক ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। কিছু আম আছে যেগুলো পাকলেও চামড়া সবুজ থাকে আর এরকম আম ক্রেতারা দেখে কিনতেই চায় না। তাই এইরকম সৌখিন ক্রেতাদের ভুলের কারণেও কেমিক্যালের ব্যবহার হয়।
ভেজাল  কিছু খাদ্য থেকে বাঁচতে নিম্নের পদ্ধতিগুলোও অনুসরণ করা যেতে পারেঃ
* ফল খাওয়ার আগে তা ভালো করে ধুয়ে নিন। ফল ধোয়ার বিশেষ ধরনের ডিটারজেন্ট পাওয়া যায় (বাচ্চাদের ফিডার নিপল পরিষ্কারের জন্য সাধারণত এ ধরনের ডিটারজেন্ট ব্যবহৃত হয়), সম্ভব হলে তা দিয়ে পরিষ্কার করে নিন। তবে সাধারণ ডিটারজেন্ট দিয়েও পরিষ্কার করা যাবে। এ ক্ষেত্রে ভালোভাবে পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে, যাতে কোনোভাবেই এটি পেটে না যায়।
* ফল খোসা ছাড়িয়ে খাবেন। কেনা ফল খোসাসহ যেমন আপেল বা আঙুর খাবেন না।
* বিদেশি ফলের পরিবর্তে দেশি ফল খান। দেশি ফলে রাসায়নিক মেশানো হয় কম।
* ফলের রং দেখে প্রলুব্ধ হয়ে কিনবেন না। টসটসে পাকা ফল না কিনে অল্প পাকা ও কম রঙিন ফল কিনুন। যদি কোনো ফলের পুরোটাই একই রঙের হয় (যেমন পুরোটাই একই ধরনের হলুদ বা লাল), সেটা এড়িয়ে চলুন। কাঁচা ফল বাড়িতে এনে ধুয়ে তারপর পাকিয়ে খান।
* সাদা মুড়ি কিনবেন না। হাতে ভাজা ও ইউরিয়ামুক্ত মুড়ি একটু হলদেটে হয়।
* ক্যানে সংরক্ষিত খাবারে প্রিজারভেটিভ বেশি থাকে। তাই এ ধরনের খাবার এড়িয়ে চলুন।
* মাছ কাটার আগেই ভালো করে কয়েকবার ধুয়ে নিন। আঁশ ছাড়িয়ে আবার ভালো করে ধুয়ে নিন। কাটার পর সম্ভব হলে ভিনেগার বা কোনো এসিডিক দ্রবণ মেশানো পানিতে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখতে পারেন (তবে ভিনেগারে ডুবানো মাছের স্বাদ পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে)।
* সবজি কাটার আগেই ভালো করে ধুয়ে নিন।
খাদ্য ও পানীয়তে বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদানের ব্যবহার আজ সর্বগ্রাসী জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। তবে এ সমস্যা সমাধান করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই খাদ্যদ্রব্যে ভেজালকে কঠোর হাতে দমন করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশেও তা সম্ভব। এ কাজে সরকারকেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে সৎ ব্যবসায়ী ও জনগণকে। এছাড়া ধর্মীয় দিক বিবেচনায় সকল ধর্মের বিচারেও ধোঁকাবাজি, প্রতারণা চালাকি ও বিশ্বাসঘাতকতা নিষিদ্ধ। বিশেষভাবে ইসলাম ধর্মে ধোঁকা ও প্রতারণার ভেজালব্যবসা কোনভাবেই বৈধ নয়, হারাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) ধোঁকা ও প্রতারণা থেকে মানুষকে সতর্ক করেছেন এবং অবৈধ ক্রয়-বিক্রয় তথা, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সকল প্রকারের প্রতারণামূলক পন্থা অবলম্বনকে হারাম ঘোষণা করেছেন।
সবারই মনে রাখা দরকার, ভেজাল মেশানো এসব খাবার যারা খাচ্ছেন, শুধু তারা কিংবা তাদের পরিবারই নয়, ভেজাল মেশানোর এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, যেমন উৎপাদনকারী, আমদানিকারক, পাইকার, ব্যবসায়ী কেউই ঝুঁকিমুক্ত নন। লাভ ও লোভের বলি শুধু ভোক্তারাই হচ্ছেন? কিন্তু তা নয়, অসাধু ব্যবসায়ীরাও এর থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছেন না।
১৮ জুন শিল্পমন্ত্রণালয় সভাকক্ষে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিং-এ শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, যখন তখন যে কোন কারখানায় ভেজাল বিরোধী অভিযান চালনো হবে। ছোট-বড় মাঝারি কোন কারখানায় বাদ যাবে না। এমনকি রাস্তার পাশের সরবত বিক্রেতার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে। শিল্পমন্ত্রী আরও বলেছেন, ঢাকা মহানগরির বাইরে পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ, সাভার, ধামরাই উপজেলাসহ বিভিন্ন উপজেলায় মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সিডিউল প্রেরণ করা হয়েছে। সিডিউল অনুযায়ী পুরো রমজান মাস জুড়ে মোবাইল কোর্ট চলবে।
ভেজালের কারণে জনস্বাস্থ্য প্রচন্ড হুমকিতে। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানোর কারণে দেশের মানুষ দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে আর তাদের পরিবার চিকিৎসাব্যয় মেটাতে গিয়ে হচ্ছে নিঃস্ব। তাই জনস্বার্থে ভেজালের বিরুদ্ধে এখনই সর্বশক্তি নিয়োগ করে ভেজাল মিশ্রণকারী ঠান্ডামাথার খুনিদের এখনই কঠোর হস্তে দমন করা অত্যন্ত জরুরি। ভেজালের ভয়াবহতায় একমুহূর্তও সময় নষ্ট না করে যেখানে ভেজালমুক্ত অভিযান সবসময় অব্যাহত রাখা প্রয়োজন সেখানে ভেজালের বিরুদ্ধে অভিযান শুধু রমজান মাসেই? সারা বছর নয় কেন? উন্নত বিশ্বে ভেজালের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে ভেজাল নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। আমাদের দেশে এ যাবত ভেজাল নির্মূলঅভিযানে যে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা আশাব্যঞ্জক নয়। আরও কঠোর পদক্ষেপ নিলে আমাদের দেশেও ভেজাল নির্মূল করা সম্ভব। তাই ভেজাল নির্মূলে আমাদেরকে সম্মিলিতভাবে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। ভেজাল নির্মূল হলে আমাদের আগামী প্রজন্ম বিকলাঙ্গের হাত হতে রক্ষা পাবে, যা সবারই কাম্য। ভেজাল দুষ্কর্ম বন্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইন করা হয়েছে। এখন সেই সর্বোচ্চ আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন আলোর মুখ দেখলেই কেবল বাংলাদেশে ভেজাল নির্মূল সম্ভব।


 আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন আলোর মুখ দেখলেই কেবল বাংলাদেশে ভেজাল নির্মূল সম্ভব।

0 Comments

There are no comments yet

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ten − one =

Back to top