ঈদ উসব সেমাই ছাড়া পূর্ণতা পায় না। তবে কেবল ঈদে নয়, সেমাই সারা বছরই নানা আয়োজনে পরিবেশন করা হয়, অতিথি আপ্যায়নেও সেমাইয়ের জুড়ি মেলা ভার। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার পছন্দের খাবারের তালিকায় রয়েছে সেমাই। পবিত্র ঈদুল ফিতর ঘিরে অসাধু সেমাই ব্যবসায়ীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে এবার বৃষ্টির কারণে বাড়ির ছাদে, খোলা জায়গায় না শুকিয়ে নোংরা ও সেঁতসঁযাঁতে ঘরে ফ্যানের বাতাসে শুকানো হচ্ছে সেমাই। এতে দেয়ালের নানা ময়লা ও ছাদের ধুলা-ময়লা সেমাইয়ে পড়ছে। এ ছাড়া ধুলাবালি আর নানা কীটপতঙ্গ তো আছেই। এদিকে সেমাই তৈরিতেও ব্যবহার হচ্ছে দূষিত পানি। পোড়া মবিলে ভাজা হচ্ছে লাচ্ছা সেমাই। ভেজাল সেমাই তৈরির হিড়িক পড়ে গেছে রাজধানীতে। তাই সেমাই কেনার আগে যাচাই করে নিন, ভেজাল কিনছেন না তো!
এদিকে যেখানে-সেখানে গড়ে ওঠা এসব অপরিচ্ছন্ন সেমাই তৈরির কারখানার কারণে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্যসম্মত সেমাই তৈরির কারখানাগুলো। প্রকৃত সেমাই কারখানার মালিকদের অভিযোগ, ভেজাল রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে কাজ করছে। কয়েকটি কারখানায় অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করলেও শতাধিক ভেজাল সেমাই তৈরির কারখানা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। চিকিসকরা জানান, অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে তৈরি হওয়া এসব সেমাই খেয়ে বমি, আমাশয়, জন্ডিস, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগ হতে পারে। এ ছাড়া পাখির মাধ্যমে বিভিন্ন ভাইরাসজনিত রোগ হতে পারে বলেও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ঈদ সামনে রেখে রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় শতাধিক ভেজাল সেমাই তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানার বেশির ভাগই গড়ে উঠেছে অবৈধভাবে। এমনকি বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির লেবেল প্যাকেটে লাগিয়ে তা বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। পুরান ঢাকার লালবাগ, হাজারীবাগ, কেরানিগঞ্জ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকায় সেমাই কারখানা গড়ে উঠলেও এখন ছড়িয়ে পড়েছে কদমতলী, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, মিরপুরের আনাচে-কানাচে। লালবাগ এলাকায়ও রয়েছে শতাধিক কারখানা। এসব কারখানার বেশির ভাগেরই বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নেই, নোংরা পরিবেশ তো আছেই।
সাজিদ ফুড প্রোডাক্টস। রাজধানীর চকবাজারের একটি সেমাই কারখানা। ভেতরের চিত্র দেখলে হয়তো অনেকেই সেমাই খাওয়া ছেড়ে দেবেন। দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল নোংরা সেঁঁতস্যাঁতে মাটিতে সেমাই তৈরির কাজ। শ্রমিকদের হাতে-পায়ে কিংবা মাথায় নেই গ্লাবস। কারখানার এখানে-সেখানে ময়লা, দেয়ালে কালচে রং। পরিবেশটা যাচ্ছেতাই, এক কথায় অস্বাস্থ্যকর বললেই চলে। আর এসব পরিবেশে সেমাই তৈরি ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ আইনের লঙ্ঘন। আইনের ৫৩ ধারা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটিকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
রমজানের প্রথম দিন থেকেই এসব ভেজাল সেমাই তৈরির প্রতিষ্ঠান ও মানহীন পানির ফ্যাক্টরিগুলো শনাক্ত করে অভিযান শুরু করেছেন ভেজালবিরোধী ভ্রাম্যমাণ আদালত। জুনের প্রথমদিকে এপিবিএন-৫-এর অভিযানে ভেজাল সেমাই তৈরি প্রতিষ্ঠান ও মানহীন পানির ফ্যাক্টরিকে চার লাখ ৮০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, ঢাকা জেলা প্রশাসন ও বিএসটিআই।
বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স ও সনদপত্র ছাড়া নামিদামি ব্র্যান্ডের লোগো ব্যবহার করে মানহীন পণ্য তৈরি করে দীর্ঘদিন গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করায় একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক সমরেশ বর্মণকে এক লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে দুই মাসের কারাদ- দেন ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদ এলাহী।
বিএসটিআই ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের যৌথ উদ্যোগে জুনের মাঝামাঝিতে র্যাব ও পুলিশের সহযোগিতায় পরিচালিত অভিযানে মাতুয়াইলের লাকী সেমাই ফ্যাক্টরিকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে লাচ্ছা সেমাই উপাদন করছিল। এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের সহসভাপতি আল আমীন দেওয়ান বলেন, ভেজালবিরোধী অভিযান চালালেই হবে না ভেজাল সৃষ্টির কারণ অনুসন্ধান করে ব্যবসায়ীদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। ওইদিন পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই চকবাজারে অভিযান চালায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ভ্রাম্যমাণ আদালত। অনেকে ভেবেছিল অভিযান চলবে চকবাজারের ইফতার বাজারে। তবে অভিযান চলল চকবাজারের সেমাইয়ের কারখানায়। অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মশিউর রহমান। প্রথমে যান সাজিদ ফুড প্রোডাক্টস নামে একটি সেমাইয়ের কারখানায়।
পরিবেশটা যাচ্ছেতাই, এক কথায় অস্বাস্থ্যকর বললেই চলে। আইনের ৫৩ ধারা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটিকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট মশিউর রহমান বলেন, চকবাজার এলাকার এই প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে সেমাই তৈরি করে বাজারজাত করছিল। সেমাই তৈরির স্থানটিও নোংরা। সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেমাই তৈরির কারণেই তাদের দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সেমাইয়ের পর চলে মিসরি ফ্যাক্টরিতে অভিযান। নাম ডায়ামন্ড মিসরি ফ্যাক্টরি। ফ্যাক্টরির চিত্রও সেমাই কারখানার ব্যতিক্রম নয়। চারপাশ ময়লা ও অস্বাস্থ্যকর। এখানেও আইনের লঙ্ঘন। তবে ফ্যাক্টরির মালিক বা ম্যানেজারকে না পাওয়ায় জরিমানা নয়, সরাসরি তা সিলগালা করা হয়।
0 Comments