ভেজাল ওষুধ আতঙ্কে দেশ, সরকারি পদক্ষেপ কি যথেষ্ট? আমাদের

বাংলাদেশে ভেজাল ও নি¤œমানের ওষুধ উৎপাদন ও বিতরণের অভিযোগে সম্প্রতি প্রায় ২০টি ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানীর লাইসেন্স বাতিল করেছে সরকার। সেই সঙ্গে আরও ৩৮টি প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি করে ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিল করে তাদের সতর্কতাও দেওয়া হয়েছে। জীবনরক্ষাকারী ওষুধ ভেজাল, নকল কিংবা নি¤œমানের হলে সেটি রোগীর প্রাণহানীর কারণ হতে পারে। কিন্তু একজন রোগী কীভাবে বুঝবে চিকিৎসকের দেয়া পরামর্শ কোন ওষুধটি ভেজাল, নকল কিংবা নি¤œমানের? আর সেসব ঠেকাতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ কি যথেষ্ট? সরকারের ‘ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর’ এর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ক্ষতিকর প্যারাসিটামল সিরাপ সেবনে ২ হাজারেরও বেশি শিশুর মৃত্যু ঘটে। ঢাকার পুরানো অংশের বাসিন্দা নূরজাহান বেগমের আড়াই বছরের শিশুটিও তাদের একজন। একদিনের জ্বর নিয়ে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হলে তিনি পরামর্শপত্রে যে প্যারাসিটামল সিরাপ লিখে দিয়েছিলেন সেটি খাওয়ানোর পর পর বাচ্চাটি বমি করে এবং কয়েক ঘন্টা পর শিশুটি মারা যায়। আশির দশক জুড়ে কয়েকটি কোম্পানীর তৈরি প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে শিশুদের কিডনী অকেজো হয়ে মৃত্যুর ঘটনাটি ব্যাপক আলোচিত ঘটনা ছিলো। গণমাধ্যমে এ নিয়ে খবর প্রকাশিত হতে থাকলে এক পর্যায়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কয়েকটি কোম্পানীর প্যারাসিটামল সিরাপ পরীক্ষা করলে তাতে ধরা পড়ে ক্ষতিকারক ড্রাই ইথিলিন গ্লাইকল নামের বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি। যা সেবনে কিডনী অকেজো হয়ে মৃত্যু ঘটতে পারে। এরপর ১৯৯২ সালে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ৫টি মামলা দায়ের করে। দুই দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে তার কয়েকটি ঘটনার বিচার হয়। এখনো কয়েকটি মামলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। রাজধানীর মহাখালিতে আইসিডিডিআরবি বা কলেরা হাসপাতালে গত কয়েক সপ্তাহে গ্রীষ্মের প্রচন্ড গরমে ডাইরিয়ার প্রকোপ বেড়ে রোগীর সংখ্যাও বেড়ে গেছে। এখানে সেবা নিতে আসা অভিভাবকদের মনেই ভেজাল ওষুধ সেবনের আতঙ্ক। চিকিৎসার প্রয়োজনে অভিভাবকরা শিশু সন্তানকে হাসপাতলে নিয়ে এলেও স্বস্তির নিঃশ্বাসে থেকেই যাচ্ছে আতঙ্ক। এখনো দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ভেজাল, নি¤œমান এবং নকল ওষুধ ধরা পড়ে। আর এ জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন অংকের অর্থ জরিমানাও করা হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ভেজাল বা নি¤œমানে ওষুধ উৎপাদনের ব্যাপকতা কতটা? শাহবাগের বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজির অধ্যাপক সাঈদুর রহমানের সাথে বিবিসি বাংলার কথা হলে তিনি বলেন, ‘ভেজাল ওষুধ শুধুমাত্র রোগ সারাচ্ছে না তা নয়, এটা শারীরিক ক্ষতির কারণ হচ্ছে। ভেজাল ওষুধের দ্রুত প্রতিক্রিয়ায় রোগী মারা যায় কিন্তু যদি এর প্রভাব ধীর গতিতে হয় তবে ৫/১০ বছর পরে হয়তো তার মৃত্যু ঘটছে। যার কারণে এর মৃত্যুর কারণ যে সেই ভেজাল বা নি¤œমানের ওষুধ, তা আর বোঝা যাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘দেশে ১শ’ রকমের প্যারাসিটামল উৎপাদন হয়। সেখানে সরকার প্যারাসিটামল পরীক্ষা করতে পারে মাত্র ১০টি। যেমন নাপারমত এরকম ২৫ হাজার ব্র্যান্ড বাংলাদেশে আছে। সরকার পরীক্ষা করতে পারে মাত্র ৪ হাজার। আর বাকি ২১ হাজার ব্র্যান্ড বছরে একবারও পরীক্ষাও হয়না।’ বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ওষুধ প্রস্তুত প্রণালী এবং মান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করে। সেই সঙ্গে বছর জুড়ে নজরদারীর কাজও করে এই প্রতিষ্ঠান। ভেজাল নকল ও নি¤œমানের ওষুধ প্রস্তুত বন্ধে সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে? এ বিষয়ে বিবিসির সাথে কথা হয় অধিদপ্তরের পরিচালক মো. রুহুল আমিনের সাথে। তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটি কতৃক একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই বিশেষজ্ঞ কমিটি ৮৪টি ঔষধের কারখানা পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। এরমধ্যে ২০টি কোম্পানীর লাইসেন্সকে বাতিল করে দেয়ার সরকারি নির্দেশ আছে। আমরা আইনী প্রক্রিয়ায় ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছি।’ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০১৫ সালে ভেজাল বা নি¤œমানের ওষুধ উৎপাদন এবং বাজার জাতকরণের দায়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ১২শ’ ৩৫টি মামলা করেছে। সেই সঙ্গে ৬৬ জন ব্যক্তিকে বিভিন মেয়াদে কারাদ- দেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রত্যেক জেলায় নজরদারীর ব্যবস্থা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। চলতি বছরের প্রথম ২ মাসে এ সংক্রান্ত ২শ’ ৫০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ৬ জন ব্যক্তিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- এবং একটি ফর্মেসি সিলগালা করে দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এ বিষয়ে রুহুল আমিন বলেন, ‘আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা প্রতিনিয়ত ওষুধের প্রত্যেকটি দোকান, পাইকারী বিক্রয় কেন্দ্র ও কারখানা পরিদর্শন করছে। এই পরিদর্শনকালে প্রশাসনকতৃক অনুমোদনহীন যেকোন ধরণের ওষুধ জব্দ করা হবে এবং সেগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশাপাশি আমরা কিছু যৌথ অভিযানও পরিচালনা করছি। সেখানে ভ্রাম্যমান আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট, র‌্যাবের সদস্য, পুলিশ বাহিনীর সদস্য এবং ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তারা থাকেন। তারা তাৎক্ষণিকভাবে অনিয়ম চিহ্নিত করে মামলা দায়ের করেন।’ বাংলাদেশে ঔষধ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে মোট উৎপাদিত ওষুধের অন্তত ২ শতাংশ অর্থাৎ অন্তত ৩শ’কেটি টাকার বেশি পরিমান অর্থের ভেজাল, নকল ও নি¤œমানের ওষুধ তৈরি হয়। এই হিসেবটি দিলেও ওষুধ কোম্পানীর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমীতির সাধারণ সম্পাদক এস এম শাফিউজ্জামান বলছেন, যারা ভেজাল ওষুধ তৈরি করেন তারা অধিকাংশই তাঁদের সমীতির সদস্য নয়। ফলে সেসব প্রতিষ্ঠানের ওপরে নিয়ন্ত্রণ তাদের অল্পই রয়েছে। ভেজাল বন্ধে সচেতন না হলে সাধারণ মানুষ হয়তো আবারও আমদানী করা ওষুধের ওপর নির্ভর করতে শুরু করবেন। তাতে দেশের ১৬ হাজার কোটি টাকার ওষুধের বাজার ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে। তাই সরকারকে কঠোর নজরদারী নিশ্চিত করে ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে সক্ষমতা বৃদ্ধি করা বিশেষ প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

0 Comments

There are no comments yet

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × 3 =

Back to top