বন্ধ হোক নকল ও ভেজাল ওষুধের

দেশে ঔষধ সম্পর্কে যে কিছু করা আবশ্যক এই উদ্বেগ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় মুদ্রিত হয় এ ভাবে-‘অনেক তথাকথিত ঔষধ নির্মাতারা আসলে এ দেশে কাঁচামাল আমদানী করে বোতলজাত করে মাত্র এবং তারা বিদেশী কোম্পানীর মূলতঃ এজেন্ট। ঔষধের মান নিয়ন্ত্রণ দুর্বল এবং নকল ঔষধের ছড়াছড়ি।তাই প্রয়োজন জীবনরক্ষাকারী ঔষধের, পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় ঔষধের, ঔষধ-নিয়ন্ত্রণ আইনের পর্যালোচনা এবং সংশোধনের।স্বাধীনতার পর পর প্রধানত বৈদেশিক মুদ্রার অভাবের কারণে টিসিবি-এর মাধ্যমে সরাসরি ইউরোপিয়ান সোস্যালিস্ট দেশগুলি হতে বিনিময় ভিত্তিতে সস্তায় জেনেরিক নামে ঔষধ কেনা হত।কিন্তু তখনই এ সমস্ত ব্যাপারে বিদেশী ঔষধ কোম্পানীগুলি এবং ঔষধ আমদানীকারকরা তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কারণে ক্ষুব্ধ হতে থাকে। তারা বিভিন্ন গুজব, বিশেষ করে সস্তায় নিম্নমানের ঔষধ আমদানী করা হচ্ছে ইত্যাদি প্রচার করতে থাকে। সে সময় দেশী-বিদেশী চাপের মুখে সরকার ঔষধ সম্পর্কে বেশী কিছু করার আর সুযোগ পায় নি।এরপর ১৯৭৭/৭৮-এর দিকে ১৯৪০ সালের ঔষধ আইন পর্যালোচনা ও প্রয়োজনীয় সংশোধনের চেষ্টা করা হয় যাতে করে প্রয়োজনীয় ঔষধ তৈরী, ঔষধ কোম্পানীর স্বেচ্ছাচারিতা, ইত্যাদি বিষয়ে কঠোর আইন প্রণয়ন করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতি, বিদেশী ও স্থানীয় বড় বড় ঔষধ কোম্পানী যার সদস্য,সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং তারা যে শুধুমাত্র ঔষধ-আইন পরিবর্তন রোধে সক্ষম হয় তাই নয় বরঞ্চ তখনকার যিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং এ ব্যাপারে যিনি সক্রিয় ও উদ্যোগী ছিলেন তাঁকে মন্ত্রিত্ব হতে অপসারণ করতেও সফল হয়।ঠিক এই সময়কালে বহির্বিশ্বে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট শাখাগুলির মাধ্যমে ঔষধনীতির সহায়ক কিছু কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয় যা উন্নয়নশীল দেশগুলির আগ্রহ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়।এ ছিল শক্তিশালী বিরোধিতার মুখে উত্তম কিছু পদক্ষেপের স্বাক্ষর।বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা স্বাভাবিকভাবেই বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এটা ঠিক যে, জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি আমলে নিয়ে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।   কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, যে ওষুধ মানুষের জীবন বাঁচায়, যে ওষুধের মাধ্যমে আরোগ্য লাভ হয়, সেই ওষুধই যখন ভেজাল বা নকল হয়ে আসে; তখন এ ধরনের পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবেই ভয়ানক বাস্তবতাকে নির্দেশ করে। দেশে নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরির বিষয়টি বারবার আলোচনায় আসে। সরকারের বিশেষ অভিযানে নকল ওষুধ তৈরির কারখানার সন্ধান মিললে মিডিয়ায় তা ফলাও করে প্রকাশ করা হয়। সরকারের ওষুধ প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। তবে কিছুদিন পর সবকিছু আগের মতো। ফার্মেসিগুলোয় নকল ওষুধ বিক্রি শুরু হয়।ওষুধ ভেজাল হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। এই ভেজাল ওষুধ সেবন করে মানুষ আরো বেশি করে রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এমনকি অনেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। দেশে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী আছে যারা ভেজাল ওষুধ তৈরি করে বাজারে ছাড়ছে। ভালো কোম্পানির যেসব ওষুধ বাজারে চালু সেসব ওষুধেই বেশি ভেজাল হচ্ছে। ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতকারীরা নামিদামি কোম্পানির ওষুধের লেবেল নকল করে ওই কোম্পানির নামেই ভেজাল ওষুধ বাজারজাত করছে। ক্রেতা সাধারণ বুঝতেই পারছে না নামিদামি কোম্পানির যে ওষুধ তারা কিনছে তা নকল। ভেজালকারীরা অনেক সময় পাইকারি ওষুধ বিক্রেতাদের মাধ্যমে তাদের নকল ও ভেজাল ওষুধ ফার্মেসিগুলোতে সরবরাহ করছে। ওষুধ সরবরাহকারীরা অনেক সময় মেয়াদ শেষ হওয়া ওষুধের লেবেল পরিবর্তন করে মেয়াদ বাড়িয়ে সেগুলোও বিক্রি করছে। এছাড়া ওষুধের দোকানগুলো নিম্নমানের চোরাইকৃত ও অরেজিস্ট্রিকৃত ওষুধ দেদারসে বিক্রি করছে। দেশের সবচেয়ে বড় ওষুধের বাজার হলো রাজধানীর মিটফোর্ড। এখানেই ভেজাল ও নকল ওষুধের ব্যবসা জমজমাট। বেশ কিছু দিন আগে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর দেশের বিভিন্ন ওষুধের দোকানে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে ১৭ কোটি টাকার ভেজাল ও অরেজিস্ট্রিকৃত ওষুধ আটক করেছিল।   ভেজাল ওষুধ বিক্রির অভিযোগে ৬১ জন ওষুধ ব্যবসায়ী ও কর্মচারীকে গ্রেফতার করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ-ও দিয়েছেন আদালত। আর এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ২ হাজার ২৯৭টি। এরপরও থেমে থাকেনি নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের দৌরাত্ম্য।মিথ্যা কারণ দেখিয়ে ঔষধের মূল্য নির্ধারণ, একই ঔষধ এক দেশে নির্মাতারা ব্যবহার উপযোগী নয় বলে নিষিদ্ধ করছে এবং অন্যদেশে তা চালু করছে, একই ঔষধের মূল্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অযৌক্তিকভাবে কম বেশী করা হচ্ছে, গবেষণা ব্যয় বেশী দেখানো হচ্ছে, লাভের অংকে আয়কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য অসম্ভব রকম কম দেখানো হচ্ছে, অপ্রয়োজনীয় ক্ষতিকারক ঔষধ প্রচলন করা হচ্ছে ইত্যাদি নানাবিধ কারণে বিভিন্ন দেশে এই সমস্ত অনিয়ম দূর করার জন্য ঔষধনীতি প্রচলনের প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। কিন্তু যখনই ঔষধনীতি প্রচলন করার চেষ্টা করা হয়েছে তখনই ঔষধ শিল্পের মালিকরা এবং সেইসঙ্গে কিছুসংখ্যক চিকিৎসকরাও এর বিরুদ্ধাচরণ করে এসেছেন। তাঁদের সেই প্রতিরোধ, প্রচার ও প্রভাব এতই শক্তিশালী ছিল যে অনেক দেশেরই উদ্যোগী সরকার ঔষধনীতি প্রয়োগ করা হতে বিরত থাকতে বাধ্য হয়েছেন। আমরা নিজেদের ও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় কিছু ঘটনা তুলে ধরতে চাই যা জানলে বুঝতে অসুবিধা হবে না যে ঔষধনীতি প্রচলন করাটা অনন্ত সংগ্রামেরই অপর নাম।ওষুধ নিয়ে বিভিন্ন সময়েই অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ওষুধ খাতে কেউ যেন কোনো প্রকার অসাধু উপায় অবলম্বন না করতে পারে সেই বিষয়টি নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। যে ওষুধ খেয়ে মানুষ।আরোগ্য লাভ করবে, সেই ওষুধই যদি জীবনের জন্য হুমকি হয়, তবে তার চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কিছু হতে পারে না।সংশ্লিষ্টদের মনে রাখা দরকার, এর আগে ওষুধের পাইকারি মার্কেটে জব্দ হয়েছিল বিপুল পরিমাণ নকল ও ভেজাল ওষুধ। মাঝেমধ্যে ভেজাল ও নকল ওষুধের বিরুদ্ধে।অভিযান চালানো হয়। এতে নকল ও ভেজাল ওষুধ উদ্ধার হলেও প্রকৃত দোষীদের অনেকেই থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।   দেশের ভেতরে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী যেমন এসব নকল ও ভেজাল ওষুধ বানিয়ে বাজারে ছাড়ছে, তেমনি আরেকটি চক্র চোরাইপথে বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়ে আসছে অনুমোদনহীন নানা ওষুধ।আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ভেজালের সঙ্গেই আমাদের বসবাস করতে হচ্ছে। এমন কোনো পণ্য মেলা ভার যেখানে ভেজালের ছোঁয়া নেই। জীবন রক্ষার জন্য মানুষ ওষুধ ব্যবহার করে। সেই ওষুধই যদি ভেজাল হয় তাহলে এর মতো দুঃখজনক সংবাদ আর কী হতে পারে! তবুও দেশে ব্যাপক হারে চলছে নকল ওষুধ তৈরি। একশ্রেণির দুর্বৃত্ত রাজধানীসহ সারাদেশে গড়ে তুলেছে ওষুধ তৈরির অবৈধ কারখানা। এসব কারখানায় নকল ওষুধ তৈরি করে বাজারজাত করা হয়। সংসদীয় কমিটির তদন্তেও ধরা পড়েছিল নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদনের চিত্র। নিম্নমানের কাঁচামাল দিয়েই শুধু নয়, আটা-ময়দা-চিনি-বেসন দিয়েও তৈরি হয় নকল ও ভেজাল ওষুধ। যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। ভ্রাম্যমাণ আদালত অপরাধীদের তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা করলেও তাতে স্থায়ী কোনো সমাধান হচ্ছে না। দেশে গড়ে উঠছে একের পর এক নকল ও নি¤œমানের ওষুধ তৈরির কারখানা। সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করে এরা হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। অথচ ওষুধের মতো জীবন রক্ষাকারী একটি পণ্য নিয়ে এ ধরনের হঠকারী ব্যবসা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা মনে করি, ওষুধ নকলকারীদের এ ধরনের লঘু শাস্তির কারণে দেশে ভেজাল ও নকল ওষুধের ব্যবসা বাড়ছে বৈ কমছে না। জরিমানার টাকা পরিশোধ করে, জামিনে বের হয়ে কিংবা শাস্তি ভোগ করে আবার একই অপকর্ম করে বেড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে অপরাধীরা। আর এই সুযোগ দেওয়ার অর্থই হচ্ছে একটি জাতিকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া। অর্থাৎ একটি জাতিকে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় হত্যা অথবা পঙ্গু করা। যা কখনো কোনো সচেতন মানুষ মেনে নিতে পারে না। সম্ভবত দেশে সচেতন মানুষের সংখ্যা নিচের দিকে নেমে গেছে। তা না হলে এতদিনে একটা বিস্ফোরণ ঘটত।সরকারি কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টাও করছেন নানা প্রক্রিয়ায়। তার মতে, পেশাদারি, মানুষের প্রতি মমত্ববোধের অভাব আর দুর্নীতির কারণে এ দেশে ওষুধ শিল্পে বিশৃঙ্খলা চলছে।  এ দেশে মানুষ গণতন্ত্রের জন্য রাস্তায় নেমে গুলি খায়। কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য কয়জন এ পর্যন্ত গুলি খেয়েছে। কেউ কি এজন্য আন্দোলন করেছে? করেনি।ভালো মানের ওষুধ বানাতে উপাদান বিদেশ থেকে আনতে হয়। এজন্য খরচ বেড়ে যায়। এ কারণে ওষুধের দাম বাড়াটা অস্বাভাবিক নয়। আমাদের দেশে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় ওষুধের দাম অনেক কম। আমরা যে ওষুধ ৪০ টাকায় কিনি সেই ওষুধের দাম আমেরিকাতে ২০০ ডলার।তাছাড়া ওষুধের মান নিয়েও তো বড় ধরনের প্রশ্ন আছে..আমাদের দুটি ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি আছে। তাদের কাজ হচ্ছে-প্রতিটি ব্যাচের ওষুধ পরীক্ষা করা। প্রতিবছর তারা তিন থেকে চার হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ পরীক্ষা করতে পারে। কিন্তু প্রতিবছর এক লাখ ব্র্যান্ডের ওষুধ বাজরে আসে। প্রতিটি কোম্পানি প্রতিবছর তিন চারটা ব্যাচে ওষুধ বাজারে আনে। তাহলে কীভাবে তারা এত ওষুধের মান যাচাই করবে?যেমন অ্যান্টিবায়োটিকে কোনো কাজ করছে না।এটা কি মান খারাপের জন্য।যে ওষুধে কাজ করছে না সেটার মান খারাপ, এটা তো বলাই যায়। আমাদের দেশে ঔষধ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করেন যেসব ব্যক্তি তারাই এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এখন যেই ব্যক্তি ওষুধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তিনি যদি অনুমোদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকেন তাহলে কিভাবে মান রক্ষায় ভূমিকা রাখবেন?চিকিৎসকদের কাছে গেলেই অতিরিক্ত ওষুধ দেওয়ার অভিযোগ আছে।এটা কতটা সত্য?চিকিৎসকরা ওষুধ কোম্পানির কাছে চুক্তিবদ্ধ হয়ে পড়েছেন। তারা সকালে লেখেন একটি প্রতিষ্ঠানের ওষুধ, তো বিকেলে লেখেন অন্যটির।এভাবে তারা সব কোম্পানিকেই খুশি রেখে কাজ করতে চান।তারা রোগীর স্বার্থের কথা কখনো চিন্তা করেন না।এ থেকে উত্তরণে কোনো পথ নেই।কারণ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের লোকরাও দুর্নীতিতে জর্জরিত। কোনো সঠিক নির্দেশনা নেই।দেশের প্রভাবশালী মহলই ওষুধ শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করে।আমি একবার এক চিকিৎসকের কাছে গেলাম,তিনি আমাকে দুটি ওষুধ দিলেন।এর একটি ভিটামিন। এর কারণ জানতে চাইলে বললেন, এটা খেলে তো কোনো সমস্যা নেই।আমি বললাম,‘এর দাম আপনি দেবেন? তখন তিনি রেগে গেলেন।আমি কথা বলার পর তিনি তখন ভিটামিন বাদ দিলেন।আমি না হয় একজন সচেতন মানুষ হিসেবে এসব বাদই দিলাম।কিন্তু সাধারণ মানুষের কী অবস্থা একটু ভেবে দেখুন।

0 Comments

There are no comments yet

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

15 − eleven =

Back to top