হবিগঞ্জে ভেজাল পণ্যে সয়লাব

ভেজাল পণ্যে সয়লাব হয়ে পড়েছে হবিগঞ্জের বাজারগুলো। খাদ্যদ্রব্যসহ এমন কোনো পণ্য নেই যেখানে ভেজাল নেই। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী গুঁড়ো মসলা, ভোজ্য তেল, ঘি, লবণ, মধু, আটা ও ময়দাসহ বিভিন্ন পণ্যে মেশাচ্ছে ভেজাল। এ চক্রটি বিভিন্ন স্থানে গোপনে গড়ে তুলেছে ভেজাল পণ্যের কারখানা। প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর মাঝে মাঝে শহর এলাকায় ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করলেও ভাটি অঞ্চলে নেই কোনো নজরদারী। এতে গ্রাম এলাকার বিভিন্ন বাজারে নির্বিঘ্নে চলছে ভেজাল পণ্যের রমরমা ব্যবসা।

আর এসব ভেজাল পণ্য খেয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন এসব এলাকার সাধারণ মানুষ।
হাওরাঞ্চলের আজমিরীগঞ্জের শিবপাশা, বানিয়াচংয়ের বড়বাজার, আদর্শবাজার ও নতুন বাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে চোখে পড়ে ভেজাল পণ্যের ছড়াছড়ি। কয়েকজন ক্রেতা ও  ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ভেজাল ব্যবসার নানা কাহিনী। তারা জানান, বাজারের অধিকাংশ পণ্যেই রয়েছে কম-বেশি ভেজাল। গুঁড়ো মসলায় মেশানো হচ্ছে করাত কলের কাঠের গুঁড়ো, ধানের কুঁড়ো, ইটের গুঁড়ো, ছানার ডাল ও নিম্নমানের আটা-ময়দা। হলুদ, ধনে, মরিচ প্রভৃতি পণ্যে এসব ভেজাল মিশিয়ে মেশিনে ক্র্যাশিং করে এর সঙ্গে রং মিশিয়ে তুলনামূলক কমদামে বাজারজাত করা হচ্ছে। দেশি গুঁড়ো মেশানো হচ্ছে নিম্নমানের আটা। গুড় ও আটা পানি দিয়ে এক সঙ্গে মিশিয়ে হালকা তাপ দিয়ে মাটির হাড়িতে ভরে বাজারজাত করা হচ্ছে। এ ছাড়া গুড়ের সঙ্গে মাটি মিশিয়েও বিক্রি করা হচ্ছে। সয়াবিনের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে কমদামি পামওয়েল। এ ছাড়া অত্রাঞ্চলে সরিষার তেলের ব্যাপক চাহিদা থাকায় সয়াবিন তেলের সঙ্গে পিয়াজের রস ও কেমিক্যাল মিশিয়ে রং ও ঝাঁঝ তৈরি করে সরিষার তেল তৈরি করা হয়ে থাকে। অসাধু ব্যাবসায়ীরা বাজার থেকে নিম্নমানের চা-পাতা সংগ্রহ করে, অনেক সময় চা-স্টল থেকে চা-পাতার বর্জ্য এনে শুকিয়ে ভালো পাতার সঙ্গে মিশিয়ে প্যাকেটজাত করে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। ঘিয়ের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে সিদ্ধ আলুর কাঁই, সুজি, পামওয়েলসহ গরু মহিষের চর্বি। মৌচাকের মধুর সঙ্গে মেশানো হচ্ছে চিনি দিয়ে তৈরি তরল রস ও মিষ্টির সিরা। এসব মধু কৌটাজাত করে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। যা গ্রামাঞ্চলের প্রথা অনুযায়ী খাওয়ানো হচ্ছে নবজাতক শিশুদের। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিক্রি হচ্ছে এসব ভোজ্য পণ্য। স্থানীয়ভাবে এক শ্রেণির অসাধু চক্র এসব ভেজাল তৈরিতে সক্রিয় রয়েছে। এ চক্রটি হবিগঞ্জ জেলা শহর, লাখাই, নবীগঞ্জ, বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জসহ ভাটি অঞ্চলের বাজারগুলোতে নকল পণ্যের মিনি কারখানা তৈরি করে রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া ভৈরব এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক এলাকা থেকে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এসব ভেজাল পণ্য আমদানি করা হচ্ছে।
জেলা শহরে সামপ্রতিককালে বিভিন্ন স্থানে ভেজালবিরোধী অভিযান জোরদার করা হয়েছে। এর ফলে এ চক্রটি শহরে অনেকটা সন্তর্পণে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে ভেজাল পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধে স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অন্যদিকে এসব পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা ভাটি এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিচালিত করছেন না ভেজাল বিরোধী কোনো জোরালো আভিযান। এতে এসব এলাকার হাট-বাজারগুলোতে এ চক্রটি নিরাপদে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের ভেজাল ব্যবসা। এর ফলে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে রয়েছে জনস্বাস্থ্য। বানিয়াচং বড় বাজারের মুদিমাল ব্যবসায়ী হানু মিয়া জানান, আমরা জেলা শহর থেকে মালামাল আমদানি করে বাজারে বিক্রি করছি। আমরা যে ধরনের পণ্য পাই তা-ই বিক্রি করি। আমাদের এখানে ভেজাল মেশানোর কোনো সুযোগ নেই। যা ভেজাল হওয়ার ওপর থেকেই আসে। নতুন বাজারের ব্যবসায়ী আমির হোসেন জানান, আমরা ভেজাল খাচ্ছি বলেই বিভিন্ন রোগ বালাইয়ের শিকার হচ্ছি। প্রশাসনের নিয়মিত কঠোর নজরদারী না থাকলে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হবে না। বাজারের সাধারণ ক্রেতা আইয়ুব আলী জানান, ‘গত সপ্তায় এক দোকান থাইক্কা কাচের বুয়ামে (পাত্র) রাখা আধা কেজি ঘি কিনছিলাম ৪শ’ টেখা দিয়া। রং খুবই সুন্দর। মুখ খুইল্যা যাছাই করলাম গেরানও আসল ঘি এর মতোই। কিন্তু বাড়িত নিয়া বুয়াম থাইক্যা ঢাইল্যা দেখি পাম ওয়েল। পরে ফালাইয়া দিতে বাদ্য অইছি।’
এ ব্যাপারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আল-আমিন মানবজমিনকে জানান, আমরা প্রতিদিন ভেজাল পণ্য ও খাদ্যদ্রব্য সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছি। পর্যায়ক্রমে আমরা বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলেও অভিযান পরিচালনা করব। এ অভিযান আরো জোরদার করা হচ্ছে। তবে শুধু অভিযানে কাজ হবে না, ক্রেতাদেরও সচেতন হতে হবে। তারা কি ক্রয় করছেন, কি খাচ্ছেন এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। তবেই অসাধু ব্যবসায়ীরা সতর্ক হবে। এ ছাড়া কোনো ক্রেতা যদি ভেজাল ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে গোপনে আমাদের অবহিত করেন, তবে আমরা এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারব।

0 Comments

There are no comments yet

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

six + sixteen =

Back to top