ভোক্তা অধিকার কি?

ভোক্তা শব্দের সঙ্গে আমরা কিছু লোক পরিচিত, কিছু লোক পরিচিত নই। ভোক্তার ইংরেজী শব্দ কনজুমার যার অর্থ ভোগকারী। অর্থাৎ কেউ কোন পণ্য, খাদ্য, পানীয় দ্রব্য বা সেবা প্রদানকারী দ্রব্য গ্রহণ করে অর্থাৎ যারা ভোগ করে তাদেরকে ভোক্তা বলে।
আইনের আওতায় ভোক্তা হলেন তিনিই যিনি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যতীত, সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে বা সম্পূণ্য বাকিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন, অথবা কিস্তিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কোনো না কোনোভাবে একজন ভোক্তা। যিনি ব্যবসায়ী বা সরবরাহকারী তিনিও একজন ভোক্তা। ভোক্তাদের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের সুফল এবং বিরোধী কার্যের কুফল সম্পর্কে জানতে হবে। ভোক্তা হিসেবে আমাদের যে অধিকার আছে তা আমরা অনেকেই জানি না। একজন উৎপাদনকারী বা ব্যবসায়ী যেমন যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ লাভ করার অধিকার রাখেন, তেমনি ভোক্তা হিসেবে ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে নেয়ার অধিকার আমাদের আছে।
ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একার পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন সকল শ্রেণীর ভোক্তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও আন্তরিক সহযোগিতা। এজন্য আইনটি সম্পর্কে সবার পর্যাপ্ত ধারণা থাকা প্রয়োজন। বিশ্বব্যাপী ভোক্তা অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন দীর্ঘদিনের। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন আছে। আমাদের দেশেও আইন রয়েছে। আইনের মূল উদ্দেশ্য হলো- ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ, উন্নয়ন, ভোক্তা অধিকার বিরোধী কাজ প্রতিরোধ, ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনজনিত অভিযোগ নিস্পত্তি, নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়া ব্যবস্থা, কোনো পণ্য বা সেবার ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তাকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা, পণ্য বা সেবা ক্রয়ে প্রতারণা রোধ এবং ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি। ভোক্তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় উলি¬খিত বিষয়গুলোকে সামনে রেখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়াধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার আইন বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং প্রত্যেক জেলার জেলা ম্যাশিষ্ট্রেট দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। সারাদেশে বাজার অভিযান চালানো হচ্ছে। ভোক্তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ অভিযানকে স্থায়ীভাবে সফল করতে প্রয়োজন সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতা এবং অংশগ্রহণ।
ভোক্তা অধিকার বাস্তবায়নে নিজেদেরকে সুসংগঠিত ও সোচ্চার হওয়া খুবই প্রয়োজন। একজন বিক্রোতা বা সরবরাহকারী ভোক্তা অধিকার বিরোধী যেসব কাজ করতে পারেন তার মধ্যেও রয়েছে নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে পণ্য বিক্রয়, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় অথবা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা, জেনেশুনে ভেজাল মিশ্রিত বা মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বা ঔষধ বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা, স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক দ্রব্য মিশ্রিত কোনো খাদ্য পণ্য বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করা, প্রতিশ্র“ত পণ্য বা সেবা যতাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করা, ওজন বা পরিমাপে কারচুপি করা, কোনো নকল পণ্য বা ঔষধ প্রস্তুত বা উৎপাদন করা, নিশিদ্ধ ঘোষিত এমন কোনো নকল পণ্য বা ঔষধ প্রস্তুত বা উৎপাদন করা, নিষিদ্ধ ঘোষিত এমন কোনো কাজ করা যাতে সেবা গ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে, অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকরণ করা, অবহেলা বা দায়িত্বহীনতা দ্বারা সেবা গ্রহীতার অর্থ বা স্বাস্থ্যহানী ঘটানো, কোনো পণ্য মোড়কবদ্ধভাবে বিক্রয়ের সময় মোড়কের গায়ে পণ্যের উপাদান, সর্ব্বোচ্চ খুচরা বিক্রয় মূল্য, মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করার  বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করা, আইনানুগ বাধ্যবাধকতা অমান্য করে দোকান বা প্রতিষ্ঠানে সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে পণ্য ও সেবার মূল্য তালিকা লটকায়ে প্রদর্শন না করা। একজন ভোক্তা, একই স্বার্থসংশি¬ষ্ট এক বা একাধিক ভোক্তা, কোনো আইনের অধীন নিবন্ধিত কোনো ভোক্তা সংস্থা, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ বা তার পক্ষে অভিযোগ দায়েরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা, সরকারি বা সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো সরকারি কর্মকর্তা এবং সংশি¬ষ্ট পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ী ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের আওতায় অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। কোনো ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘন হলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর-এ অভিযোগ দায়ের করা যাবে। তবে কারণ উদ্ভব হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ দায়ের করা করতে হবে। এ সময়ের পর অভিযোগ করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাৎক্ষণিক ভাবে জরিমানার ২৫ শতাংশ অর্থ অভিযোগকারীকে প্রদান করা হচ্ছে। অভিযোগ করার সময় নির্ধারিত কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করা প্রয়োজন। অভিযোগ অবশ্যই লিখিত হতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারের ভোক্তা সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এর দন্ডবিধি
১। সঠিক মোড়ক ব্যবহার না করার দন্ড ঃ মোড়ক ব্যবহার, পণ্যের ওজন, পরিমান, উৎপাদন, ব্যবহারবিধি, বিক্রয় মূল্য, উৎপাদন তারিখ, প্যাকেটজাত করণের তারিখ, মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ স্পষ্ট করে লিখতে হইবে। এই বিধি লঙ্ঘন করিলে অনুর্ধ্ব ১ বছর কারাদন্ড অথবা ৫০,০০০/- (পঞ্চাশ হাজার টাকা) জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।
২। মূল্যের তালিকা প্রদর্শন ও সংরক্ষণ না করার দন্ড ঃ এই বিধি লঙ্ঘন করিলে অনুর্ধ্ব ১ বছর কারাদন্ড অথবা ৫০,০০০/- (পঞ্চাশ হাজার টাকা) জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।
৩। ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে বিক্রির দন্ড ঃ এই বিধি লঙ্ঘন করিলে অনুর্ধ্ব ১ বছর কারাদন্ড অথবা ৫০,০০০/- (পঞ্চাশ হাজার টাকা) জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।
৪। ক) ভেজাল পণ্য / ঔষধ বিক্রয়ের দন্ড ঃ
১.    খ) খাদ্য পণ্য নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণের দন্ড ঃ এই বিধি লঙ্ঘন করিলে অনুর্ধ্ব ৩ বছর কারাদন্ড অথবা ২,০০,০০০/- (দুই লক্ষ টাকা) জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।
৫। অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন / প্রক্রিয়াকরণের দন্ড ঃ এই বিধি লঙ্ঘন করিলে অনুর্ধ্ব ২ বছর কারাদন্ড অথবা ১,০০,০০০/- (এক লক্ষ টাকা) জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।
৬। মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা প্রতারিত করার দন্ড ঃ এই বিধি লঙ্ঘন করিলে অনুর্ধ্ব ১ বছর কারাদন্ড অথবা ২,০০,০০০/- (দুই লক্ষ টাকা) জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।
৭। প্রতিশ্র“তপণ্য বিক্রয় অথবা সরবরাহ না করার দন্ড ঃ এই বিধি লঙ্ঘন করিলে অনুর্ধ্ব ১ বছর কারাদন্ড অথবা ৫০,০০০/- (পঞ্চাশ হাজার টাকা) জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।
৮। ওজনে কারচুপি অথবা ওজন পরিমাপক যন্ত্রে কারচুপি করার দন্ড ঃ এই বিধি লঙ্ঘন করিলে অনুর্ধ্ব ১ বছর কারাদন্ড অথবা ৫০,০০০/- (পঞ্চাশ হাজার টাকা) জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।
৯। পরিমাপক ফিতার কারচুপি ঃ এই বিধি লঙ্ঘন করিলে অনুর্ধ্ব ১ বছর কারাদন্ড অথবা ৫০,০০০/- (পঞ্চাশ হাজার টাকা) জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।
১০। নকল পণ্য প্রস্তুতি অথবা উৎপাদন করার দন্ড ঃ এই বিধি লঙ্ঘন করিলে অনুর্ধ্ব ১ বছর কারাদন্ড অথবা ২,০০,০০০/- (দুই লক্ষ টাকা) জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।
১১। মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য অথবা ঔষধ বিক্রয়ের দন্ড ঃ এই বিধি লঙ্ঘন করিলে অনুর্ধ্ব ১ বছর কারাদন্ড অথবা ৫০,০০০/- (পঞ্চাশ হাজার টাকা) জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।
১২। সেবা গ্রহীতার জীবননাশ অথবা নিরাপত্তা বিপন্নকারী কার্য করা ঃ এই বিধি লঙ্ঘন করিলে অনুর্ধ্ব ১ বছর কারাদন্ড অথবা ২,০০,০০০/- (দুই লক্ষ টাকা) জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।
১৩। অবহেলা দ্বারা সেবা গ্রহীতার অর্থ, স্বাস্থ্য, জীবনহানী ইত্যাদি ঘটাইবার দন্ড ঃ এই বিধি লঙ্ঘন করিলে অনুর্ধ্ব ১ বছর কারাদন্ড অথবা ২,০০,০০০/- (দুই লক্ষ টাকা) জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।
১৪। অপরাধ পুনঃ সংগঠন দন্ডঃ দ্বিগুন দন্ডে দন্ডিত।
১৫। মিথ্যা অথবা হয়রানীমূলক মামলা দায়েরের দন্ড ঃ এই বিধি লঙ্ঘন করিলে অনুর্ধ্ব ১ বছর কারাদন্ড অথবা ২,০০,০০০/- (দুই লক্ষ টাকা) জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।

0 Comments

There are no comments yet

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eleven + thirteen =

Back to top