ভেজাল মেশানো হয় কঠোর গোপনীয়তায় পুরান ঢাকায় ভেজাল খাদ্যের শতাধিক কারখানা
ঢাকার কারওয়ান বাজারে এ রকম বেশ কয়েকটি ঘুপচি ঘরে অতি গোপনে ফলে রাসায়নিক মেশানো হয়। গত বৃহস্পতিবার ছবি তুলতে গেলে আগেই টের পেয়ে সংশ্লিষ্টরা কেটে পড়ে। ছবি : তারেক আজিজ নিশক
বৃহস্পতিবার, ঘড়িতে দুপুর ১২টা। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ফলের আড়ত। সারি সারি লিচু আর আম সাজিয়ে রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। অন্য মৌসুমি ফলও আছে। ফলের আকর্ষণীয় বর্ণনা দিয়ে ক্রেতা ভেড়ানোর চেষ্টা চলছে। পাশে খাঁচি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন কিশোরগঞ্জের নিকলী থেকে আসা শ্রমিক সুরুজ মিয়া। কেউ ফল কিনলে তা বহন করাই তাঁর কাজ।
পরিচয় গোপন রেখে খাতির জমিয়ে ফলের বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে গলা নামিয়ে সুরুজ বলেন, ‘ভাই, এসব কিইন্ন্যা খাওয়ার চেয়ে না খাওয়া বালা। আমরা সারা দিন এইহানে কাম করি। ভুলেও কোনো দিন এসব খাই না। কারণ নিজের চোহের সামনে বিষ মিশানো দেহি।’ কোথায় ফলে বিষ মেশানো হয়- জানতে চাইলে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যান। কিছুটা ভেবে সঙ্গে যাওয়ার ইঙ্গিত করেন। কিছু দূর হাঁটার পর ফলের একটি মার্কেট দেখিয়ে দিলেন। জানালেন, এ জায়গাতেই ফরমালিন ড্রামে ঢেলে পানির সঙ্গে মেশানো হয়।
দেখা গেল বাইরে ছোট ছোট দরজা। সুরুজের দাবি, দরজার ওপারে রয়েছে বিশাল গুদাম। গাড়ি থেকে ফল নামানোর পর সেখানে রাখা হয়। তারপর সুবিধামতো সময়ে মেশানো হয় ফরমালিন। একটু পর সুরুজ বললেন, ‘আমি এহ্যান থেকে চলে যাই। ওরা আমারে ভালো কইরাই চিনে। হেদের গোডাউন থেইক্যা ফল মাথায় কইরা বাজারে লইয়া যাই। বুঝতে পারলে মারপিট করব।’ সুরুজের কথার সত্যতা খুঁজতে একটু এগিয়ে ছোট ছোট দরজার ভেতরে কি জানতে চাইলে আড়তে কর্মরতরা জানান, ভেতরে ফল রাখা হয়। একটু দেখা যাবে কি না- উত্তর এলো ‘না’।
সরেজমিনে গিয়ে ঘুরে উত্তর কারওয়ান বাজারে মোহাম্মদ মুসলিম পাটোয়ারীর মালিকানাধীন মেসার্স ফরহাদ ট্রেডার্স এবং আলী আজম খান ও মানিক ভুঁইয়ার মালিকানাধীন মেসার্স শাহ আলী ফার্ম নামে দুটি আড়তের দেখা মিলল। বাইরে ছোট ছোট দরজা। দেখলে কেউ বুঝবে না ভেতরে কিছু আছে। এখানেই ফল রেখে রাসায়নিক মেশানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে স্বদেশ ফার্ম নামের আরেক আড়তের মালিক ফিরোজ আলম কালের কণ্ঠের কাছে দাবি করেন, আড়তে তাঁরা কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করেন না। তিনি বলেন, ‘আমরা মূলত প্রান্তিক কৃষকের কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে তাদের মাধ্যমেই ফলের চাষ করি। বিনিময়ে একটা লভ্যাংশ পাই। যে পরিমাণ কেমিক্যাল স্প্রে হয়, তা বাগানেই হয়।’ ফিরোজের ভাষ্যমতে, ‘যেসব কেমিক্যাল মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর তা আমদানি বন্ধ করা ও মাঠপর্যায়ে ব্যবহার প্রতিরোধ করতে হবে। কারণ আমরা টাকা দিয়ে গ্রাম থেকে ফল ক্রয় করার পর তা পরীক্ষা করে বলা হয়- বিষাক্ত। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।’
রাজধানীর মিরপুরের শাহআলী মাজারের দক্ষিণ পাশের মার্কেটে গিয়ে দেখা গেল, ফরমালিন মেশানোর নানা উপকরণ রাখা হয়েছে। পুরো মার্কেটেই ফলের আড়ত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগ দোকানে নেই সাইনবোর্ড। দোকানে দেখা যায়, বড় আকৃতির একাধিক ড্রাম রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ মার্কেটের এক দোকান কর্মচারী জানান, এখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মৌসুমি ফল আসে। ফল এনে গাড়ি থেকে নামানোর পরই গভীর রাতে আড়তে রেখে ফরমালিনসহ নানা ধরনের কেমিক্যাল স্প্রে করা হয়। এখানে সব দোকানেই ফরমালিন মেশানোর সব সরঞ্জাম রয়েছে।
এ ব্যাপার র্যাব-৪-এর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আল-আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, “ফলে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করে। খাদ্যে টেক্সটাইল কালার ও হাইড্রোজ নামের রাসায়নিকদ্রব্য ব্যবহার করে। ইদানীং শুঁটকিতে দেওয়া হয় ‘ডিডিটি’ নামক একটি রাসায়নিক উপকরণ। এগুলো বন্ধে ভোক্তাদের আরো সচেতন হতে হবে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের আরো মানবিক আর আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।”
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জিলাপি ও চানাচুরে মবিল, মসলায় ভুসি, কাঠ, বালি, ইটের গুঁড়া ও বিষাক্ত গুঁড়া রং, ইসবগুলের ভুসিতে ভুট্টার গুঁড়া মেশানো হচ্ছে। টেক্সটাইল ও লেদারের রং মেশানো হচ্ছে সস্তা মানের বিস্কুট, আইসক্রিম, জুস, সেমাই, নুডলস ও মিষ্টিতে। মুড়িতে মেশানো হচ্ছে হাইড্রোজ।
খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানোর কথা এলেই সবার আগে আসে পুরান ঢাকার বেগম বাজার, চক বাজার, শ্যামবাজারের নাম। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব এলাকার প্রায় ১০০ কারখানায় চকোলেট, আইসক্রিম ও জুসের নামে তৈরি হচ্ছে বিষাক্ত খাবার। শিশুদের পছন্দের ‘পাইপ’ আইসস্ক্রিম আর চকোলেটে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল। ফরমালিন, কার্বাইড, কাপড়ের রং, মোম, স্যাকারিন, সোডা, আটা-ময়দা, সুগন্ধি পাউডার, ট্যালকম পাউডার, পচা তেঁতুল, পচা আম, পচা আমড়া ও ঘনচিনি দিয়ে তৈরি করা বিভিন্ন প্রকারের জুস, পাইপ আইসক্রিম, চকোলেট, চুইংগাম, আচার, সন্দেশ ও বরফিসহ অর্ধশতাধিক শিশুখাদ্য। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে কারখানা ও দোকানগুলোতে নেই কোনো ব্যানার বা সাইনবোর্ড। এসব বিষাক্ত পণ্যের ব্যাপারে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) অভিযান চালিয়েছে একাধিকবার। কিন্তু নামমাত্র জরিমানা আর লঘুদণ্ডের ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা উৎপাদন থেকে সরছে না। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি অভিযানে বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত চকোলেট ও আইসক্রিমের কারখানার সন্ধান পেয়ে তা সিলগালা করে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু থেমে নেই বিষাক্ত শিশুখাদ্য উৎপাদন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুরান ঢাকায় অধিক মুনাফার লোভে এ ব্যবসাকে কেন্দ্র করে শতাধিক কারখানা গড়ে উঠেছে বেগম বাজার, ছোট কাটারা, বড় কাটারা, কামালবাগ, ইসলামবাগ, শহীদনগর, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীর চর, কেরানীগঞ্জ, শনির আখড়া ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী কিছু এলাকায়। এ ব্যবসায় জড়িত রয়েছে কয়েক শ অসাধু ব্যবসায়ী। স্থানীয় থানা পুলিশকে নিয়মিত মাসোয়ারা দিয়ে এ ব্যবসা চলছে। বেগম বাজারের হোসেন ম্যানশন, শওকত ম্যানশন, হাসিনা মার্কেট, করিম ম্যানশন, ভাই ভাই ম্যানশন, রিফাত ম্যানশন ও চাম্পাতলীর বিভিন্ন দোকানে এসব ভেজাল খাদ্য পাইকারি বিক্রি হচ্ছে। অভিযোগ পাওয়া যায়, স্থানীয় পুলিশকে হাত করে ব্যবসা চালানো হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে এ কাজ করছে ওহিদ মিয়া নামের স্থানীয় এক ব্যবসায়ী। তবে ওহিদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘এখানে অবৈধভাবে অনেক মানুষ বিষাক্ত শিশুখাদ্য উৎপাদন করছে। তবে তাদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।’
বেগম বাজারের ব্যবসায়ী মনির হোসেনের পাইপ আইসক্রিম ও জুসের কারখানা রয়েছে শনির আখড়ায়। তাঁর এ ব্যবসার সব পরিচালনা করেন ছোট ভাই মিরাজ। পরিচয় গোপন রেখে মিরাজের কাছে জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, আমরা সারা দেশেই আইসক্রিম ও চকোলেট সরবরাহ করি। এসব খাদ্য উৎপাদনে অনুমোদন আছে কি না জানতে চাইলে তিনি ফোন রেখে দেন। জাহাঙ্গীর হোসেনের পাইপ আইসক্রিম ও জুসের কারখানা রয়েছে কামরাঙ্গীর চরের পূর্ব ইসলামনগর আজিজিয়া মাদ্রাসাসংলগ্ন এলাকায়। শাহিনের পাইপ আইসক্রিমের কারখানা রয়েছে মোমিনবাগ এলাকায়। রাজ্জাকের পাইপ আইসক্রিমের কারখানা রয়েছে পূর্ব ইসলামনগরে। বেলায়েতের পাইপ আইসক্রিম ও জুসের কারখানা রয়েছে কামরাঙ্গীর চরের তাজ হারিকেন কারখানার পাশে। সিদ্দিকের পাইপ আইসক্রিম ও বরফির কারখানা রয়েছে ঝাউলাহাটি এলাকায়। বেগম বাজার রিফাত ম্যানশনে শাহিন স্টোরের মালিক শাহিনের পাইপ আইসক্রিম, জুস ও বরফির কারখানা রয়েছে তাঁর বাসার পাশেই।
এসব বিষাক্ত খাদ্যে শিশুদের কি ধরনের সমস্যা হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও বিএসটিআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ড. গোলাম মাওলা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এসব বিষাক্ত খাবার খেয়ে শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। শিশুর খাদ্যনালি, কিডনি নষ্ট হতে পারে। বমি, ডায়রিয়াসহ কখনো কখনো অঙ্গহানিও ঘটতে পারে। এসব খাবার বন্ধ করতে চাইলে উৎপাদনকারীদের নিয়ে সভা-সেমিনারের মাধ্যমে সচেতনা বৃদ্ধিসহ কঠোর আইন প্রয়োগ একান্ত জরুরি।’
পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অবৈধ কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান চালায় বিএসটিআই। আর অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে যদি কোনো পুলিশ তাদের সহযোগিতা করে, তবে প্রমাণসাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
0 Comments