স্ট্রিট ফুড ব্যবসা, ভেজাল ও করণীয়

একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে ইফতারিতে ভেজাল নিয়ে এক বিশেষজ্ঞের ভাষ্য শুনছিলাম সম্প্রতি। বক্তব্যের একপর্যায়ে তিনি রাস্তার ইফতারির বদলে সবাইকে বাসায় ইফতারি বানাতে পরামর্শ দিচ্ছিলেন। কিন্তু বাজার অর্থনীতির যুগে ইফতারি ব্যবসা শুধু যে হাজারো মানুষের জীবিকার নিশ্চয়তা দিচ্ছে তা নয়, এই সহজলভ্য ইফতারি বাঁচিয়ে দিচ্ছে লাখো মানুষের সময় ও কষ্ট। তাই শুধু ইফতারি বানানোর জন্য কর্মজীবী মানুষদের অফিস বা ব্যবসা ফেলে তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার আইডিয়া উৎসাহিত করা যায় না। বরং আইনের যথাযথ কার্যকরীকরণ ও কিছু সংযোজন বা সংশোধন করে যদি ইফতারি ব্যবসা বা স্ট্রিট ফুড বিজনেসকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ ও ভেজালমুক্ত করা যায়, তাহলে সেটাই হওয়া উচিত সময়ের দাবি।

রোজা যদিও সংযমের মাস, কিন্তু আমাদের দেশে মাসটি এলেই সংযমের বদলে শুরু হয়ে যায় অতিরিক্ত খাওয়াদাওয়ার উৎসব। আর এই ধর্মীয় উৎসবকে পুঁজি করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী শুরু করে ব্যবসার নামে ভেজাল ও বিষাক্ত খাবারের এক লাগামহীন যজ্ঞ। রোজার দিনে দুপুরের পর থেকেই শহর বা গ্রামের রাস্তায়, পাড়ায়, অলিতে-গলিতে শুরু হয়ে যায় ইফতারি তৈরির আয়োজন। বিকাল থেকে পুরোদমে শুরু হয়ে যায় ইফতারি ব্যবসা। ক্রেতারও অভাব নেই; দেদার চলে বেচাকেনা। উৎসবপ্রবণ বাঙালি জীবনের এই জমজমাট ইফতারি কেনাবেচায় প্রকৃতপক্ষে কারো কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা বাধে তখনই, যখন রাস্তার ইফতারিতে খাবারের নামে বিক্রি হয় বিষাক্ত ও নোংরা অখাদ্য। সম্প্রতি বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে উঠে এসেছে ফুটপাত বা রাস্তায় ইফতারি ব্যবসার ভয়াবহ চিত্র। জিলাপি ও মিষ্টিতে মেশানো হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইট (হাইড্রোজ)। বেগুনি, চপ, কাবাব, পেঁয়াজু, ছোলাসহ অন্যান্য খাদ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে খাওয়ার অনুপযোগী পুরনো ও বিষাক্ত পাম অয়েল। জিলাপি, রসগোল্লা, চমচমসহ অন্যান্য মিষ্টিজাতীয় খাবারে চিনির পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে সোডিয়াম সাইক্লামেটের মতো মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর রাসায়নিক। তদুপরি ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো খাবারগুলোকে আকর্ষণীয় করতে এসব খাদ্যে মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর টেক্সটাইল বা কাপড়ের রঙ। ইফতারি ব্যবসার এ রকম ভয়াবহ চিত্র প্রতি রমজানের নিয়মিত খবর। তার পরও অবাক করার মতো বিষয় হলো, প্রশাসন এ ব্যাপারে সুদূরপ্রসারী এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ম্যানুফ্যাকচারিং ফুড ইন্ডাস্ট্রি নিয়ন্ত্রণের পেছনে অজস্র সময় ব্যয় করলেও রাস্তার ইফতারি ব্যবসা তথা স্ট্রিট ফুড বা ফুটপাতের খাবার নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের উদাসীনতা হতাশাজনক। কারণ সীমিত সংখ্যক ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়, তাদের বেশির ভাগই সুপারমার্কেটের খাবার দোকান বা স্থায়ী হোটেল-রেস্তোরাঁয় অভিযান চালান। উল্লেখ্য, স্ট্রিট ফুড বিজনেস নিয়ন্ত্রণে আলাদা করে কোনো বিধান বর্তমান আইনে রাখা হয়নি। যেমন— সদ্য পাস হওয়া নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩-এর ২(৯) ধারায় ‘খাদ্য ব্যবসায়ী’ বলতে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আপাতত বলবৎ কোনো আইনের অধীন বা প্রবিধান অনুযায়ী যিনি খাদ্য ব্যবসা পরিচালনা করেন এবং যিনি ওই ব্যবসার প্রতি দায়িত্বশীল বা ব্যবসার স্বত্বাধিকারী, তাকে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু ওই ব্যক্তিকে খাদ্য ব্যবসা রেজিস্ট্রেশন করতে হবে কিনা বা হলে তা কোন নিয়মে করতে হবে, তার সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা আইনের বিধিমালায় উল্লেখ নেই। অথচ স্ট্রিট ফুড যে হারে বাড়ছে, আগামীতে হয়তো বহু মানুষ এদিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। শুধু আমাদের দেশে নয়; ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায়ও স্ট্রিট ফুডের চল দিন দিন বাড়ছে। সে কারণে ওসব দেশে স্ট্রিট ফুড নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট কার্যকর আইন প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গে মিউনিসিপ্যাল অথরিটি বা লোকাল ফুড ইন্সপেক্টরদের কড়া নজরদারি চোখে পড়ার মতো।

এ পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান নিবন্ধে স্ট্রিট ফুড নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন উন্নত দেশের আইনকানুনের আলোকে কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরতে চাই। সর্বপ্রথম, যারা রাস্তায় ইফতারি ব্যবসা বা স্ট্রিট ফুড বিজনেস করতে চান, তাদের সবাইকে একটি রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই রেজিস্ট্রেশন হতে পারে খাদ্য মন্ত্রণালয় অথবা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে। সিটি করপোরেশন, জেলা বা উপজেলা পরিষদের অধীনেও হতে পারে। রেজিস্ট্রেশনের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বিবেচনায় আনতে হবে। প্রথমত. যারা স্থায়ীভাবে স্ট্রিট ফুড বিজনেস করতে আগ্রহী বা রমজানে ইফতারি ব্যবসা করতে চান, তাদের বিএসটিআই কর্তৃক নির্ধারিত নিরাপদ খাদ্য তৈরি ও পরিচর্যার বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে। এ বিষয়ে বিএসটিআই শর্ট কোর্স চালুর ব্যবস্থা করতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খাবারের দোকানে ফুড সেফটি বিষয়ে অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান আছে— এমন একজনকে রাখা হয়, যিনি সেই দোকানে খাবার তৈরির সময় এর মান ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে কিনা, তা দেখেন। বাংলাদেশেও এ ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যখন কোনো স্টলে খাবার তৈরি করা হবে, তখন সেই স্টলে ওই ফুড সেফটি বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিটিকে উপস্থিত থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে স্ট্রিট ফুডের মালিক বা ইফতারি ব্যবসায় নিয়োজিত ব্যক্তিটি যদি নিজেই বিএসটিআইয়ের কোর্সটি করেন, তাহলে সহজেই তিনি পরিচ্ছন্ন ও ভেজালমুক্ত খাবার তৈরি করতে পারবেন। দ্বিতীয়ত. যার নামে স্ট্রিট ফুড বিজনেস বা ইফতারি ব্যবসাটি রেজিস্ট্রেশন করা হবে, তার পাসপোর্ট বা ভোটার আইডি সংরক্ষণ করতে হবে, যাতে সেই ফুড স্টলে কোনো ভেজাল খাবার বানানো হলে স্টলের মালিককে সহজেই শনাক্ত করা যায়। তৃতীয়ত. একটি ফুড স্টল কোথায় তার ব্যবসা পরিচালনা করবে, সে জায়গার নামও রেজিস্ট্রেশনে উল্লেখ থাকতে হবে। আর যদি মুভিং ভ্যানে কোনো খাবার স্টল অনুমোদন পায়, তাহলে ভ্যানটি শুধু ওই নির্দিষ্ট এলাকায় খাবার বিক্রি করতে পারবে। রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত কেউ যখন রাস্তায় খাবার বা ইফতারি বিক্রি করতে আসবেন, তখন তাকে রেজিস্ট্রেশন নাম্বারসহ রেজিস্ট্রেশনপত্রটি লেমিনেট করে স্টলের সামনে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। এতে ফুড ইন্সপেক্টর বা মোবাইল কোর্টের কোনো অফিসার যখন ওই স্টলটি পরিদর্শন করতে আসবেন, তখন সহজেই এর মালিকসহ সব তথ্য শনাক্ত করতে পারবেন। সর্বোপরি খাদ্য পরিদর্শক বা মোবাইল কোর্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে। যাতে প্রতিটি এলাকায়, পাড়ায় প্রত্যেকটি রাস্তার খাবারের দোকানে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা যায়।

পরিশেষে, গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়া নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ পূর্বে প্রণীত খাদ্য-সংক্রান্ত সব আইনকে এক করে একটি প্লাটফর্মের নিচে আনার ব্যবস্থা করেছে, যা বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম সফলতা। তাই এ আইনের বাইরে স্ট্রিট ফুড বা ইফতারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নতুন কোনো আইন বা বিধি করার কথা বলার প্রয়োজন নেই। বরং ২৯ অক্টোবর, ২০১৪তে এ আইনের যে বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে, তাতে স্ট্রিট ফুড এবং ইফতারি ব্যবসাকে সুনির্দিষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করে ফুটপাতের বা রাস্তার খাবারের দোকানগুলোকে রেজিস্ট্রেশন ও নিয়মিত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করে সবার জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার বা ইফতারির ব্যবস্থা করা সম্ভব।

0 Comments

There are no comments yet

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 × 1 =

Back to top