প্রসঙ্গ : ভেজাল খাবার

এই মুহূর্তে খাদ্যে ভেজাল আমাদের দেশের এক বিরাট জাতীয় সমস্যা। ঋতুবৈচিত্র্যের বাংলাদেশে এই সময়টাকে মধুমাস বলা হয়। কারণ এ সময় আম-কাঁঠাল-লিচু-জাম-তালের শাঁস ইত্যাদি রসাল ফলে বাজার ভরে ওঠে। অথচ সেই মধুর স্বাদ আমরা দিন দিন হারিয়ে ফেলছি। সবচেয়ে বিপদে আছি আমরা, যারা সরাসরি জনগণের সঙ্গে খাদ্য পরামর্শক হিসেবে কাজ করছি। যখনই কোনো রোগীকে খাদ্যব্যবস্থাপনা দিচ্ছি, তখনই অপর দিক থেকে প্রশ্ন আসছে- ম্যাডাম, কী খাব, কোনটা খাব? সত্যিই তো? ভাত-রুটি-মুড়ি, মাছ-মাংস-দুধ-ফল-শাকসবজি- কী খাবেন তাঁরা? অভিযোগ পাওয়া যায়, মিডিয়ার কল্যাণে প্রায় সব কিছুতেই ভেজাল। শাকসবজিতে কাপড়ের রঙ, মাছ-মাংসে এমনকি বিস্কুটে ফরমালিন, ফলমূলে কার্বাইড। যেটা সত্য সেটা হলো, পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য শাকসবজি, ফলমূলে কীটনাশক দেওয়া হচ্ছে, কাঁচা ফল পাকানোর জন্য কার্বাইড, খাদ্যদ্রব্যের পচন রোধ করার জন্য ফরমালিন, ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার জন্য কাপড়ের রং যেমন আলতার রঙে রাঙানো লিচু অতি মনোহর! তার মানে একই খাবারে অনেক রকম রাসায়নিক! এত রাসায়নিকের দাপটে আমাদের জীবন সত্যিই সংকটাপন্ন।

এই সমস্যা সমাধানে সরকারিভাবে বারবার প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এর সঙ্গে একটি বিষয় তাঁরা বলছেন- জনগণের সচেতনতা প্রয়োজন। কিন্তু জনগণ তো অসহায়। রাসায়নিকের বেড়াজালে আবদ্ধ।

আমি মনে করি, খুব ছোট ইলিশ বা জাটকা ধরা বন্ধ করে গত বছর সরকার জনগণকে ইলিশ মাছের স্বাদ গ্রহণের যেমন সুযোগ দিয়েছে, তা সত্যিই সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তেমনি ভেজালবিরোধী সরকারি পদক্ষেপ গ্রহণ ও কঠোর আইন ও এর প্রয়োগ দিয়েই সমস্যাটি মোকাবিলা করা সম্ভব।

আজ সময় এসেছে, খাদ্যে ভেজালকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার। যুদ্ধাপরাধীর মতো এরাও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারী। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বুদ্ধিহীন, মানসিক প্রতিবন্ধী, শারীরিক বিকলাঙ্গ ও চরম অসুস্থতার দিকে কারা ঠেলে দিচ্ছে? এ ধরনের ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে হবে। এতে সরকারের যেমন ভূমিকা আছে, তেমনি প্রয়োজন জনগণের সচেতনতা। এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার এই যে খাদ্যদ্রব্য ও ফলমূলে ব্যবহৃত রাসায়নিক পণ্যগুলো সহজলভ্য কেন হবে? ক্ষতিকর সেসব রাসায়নিকের ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবহার কেবল লাইসেন্স দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন দুদকের মতো খাদ্যে ভেজাল দমন কমিশন গঠন করা যেতে পারে। বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে পাকা ফলের স্বাদ আর গন্ধ আজ আর কেউ পায় না। আমাদের সন্তানরা ফলের প্রকৃত স্বাদ-ঘ্রাণ-বর্ণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তারা জন্মেই দেখছে স্বাদহীন আম-কাঁঠাল, কলা, পাকা পেঁপে ইত্যাদি। তাহলে তারা সেসব ফল খেতে আগ্রহী কেন হবে? স্বভাবতই তারা ঝুঁকে পড়ছে জাঙ্ক ফুডের দিকে, যা পরবর্তী সময়ে উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল ও ওজনাধিক্য এবং ভিটামিনের মারাত্মক অভাবে বিভিন্ন রোগের জন্ম দিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

ভেজালেও ভেজাল। ফরমালিনমুক্ত বাজারেও ফরমালিনযুক্ত খাদ্যদ্রব্যের সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাসায়নিক ছাড়াও ভেজাল রয়েছে যেমন- ঘি ও বাটার অয়েলে আছে সিদ্ধ গোল আলু এবং মিষ্টি আলুর মণ্ড, চা পাতায় নাকি বুটের অথবা মাষকলাই ডালের খোসা, টমেটোর সসের পরিবর্তে চালকুমড়ার রং মিশ্রিত সস, সাদা চিনিতে চক পাউডার। গোলমরিচে পাকা পেঁপের বিচি। হলুদে কৃত্রিম হলুদ রং। মরিচে ইটের গুঁড়া বা কৃত্রিম রং। ধনে গুঁড়ায় কাঠের গুঁড়া, চালে পাথর, সাদা আটায় ভুট্টার আটা। লবণে সাদা পাথরের গুঁড়া ও চক পাউডার। দইয়ের ভেতর পাকা কলা, মধুতে গুড় বা চিনি-পানি, দারুচিনিতে অন্য গাছের ছাল, সত্যিকারের দারুচিনি হয় পাতলা ও গোল। অন্য গাছের ছাল হয় শক্ত ও মোটা। কফিতে তেঁতুল ও খেজুরের বীজের গুঁড়া ইত্যাদি এই তালিকা কম দীর্ঘ নয়।

দেখা যায়, খাদ্যে রাসায়নিকের কারণে খাদ্য বিপর্যয় ঘটে। যেমন- হৃদরোগ, মস্তিষ্কের রোগ, মাথাব্যথা, বমি, পেটব্যথা, কিডনির অসুখ, লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।

সুতরাং ভেজাল খাবারের বিরুদ্ধে আরো সোচ্চার হোন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভালোভাবে বাঁচতে সাহায্য করুন। সর্বোপরি খাবারের প্রকৃত স্বাদ গ্রহণ করুন।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, পুষ্টি বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল

– See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2014/06/17/97148#sthash.rXEryatj.dpuf

0 Comments

There are no comments yet

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nine − 7 =

Back to top